গরম শুরু হওয়ার সাথে-সাথে বান্দরবান জেলায় সব ঝিরি-ঝর্ণা আস্তে আস্তে শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে পুরো বান্দরবান জেলায়। বান্দরবান চিম্বুক-নীলগিরি-থানচি সড়কের দুইপাশে ১১০টি ম্রো পাড়াসহ লামা, আলিকদম, রুমা, রোয়াংছড়ি, থানচি উপজেলার দুর্গম এলাকার পাহাড়ী পল্লীগুলোতে বিশুদ্ধ পানির সংকট অনেক বেশী বলে জানা গেছে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গরমের শুরুতেই বান্দরবান জেলার বিভিন্ন উপজেলার পাড়াবসতির নিকটবর্তী পানির উৎসস শুকিয়ে গেছে। কোথাও-কোথাও ঝিরির শেষ মাথায় গর্তে জমে থাকা অল্প পানি থেকেই বিভিন্ন পাড়ার ম্রো নারীরা পানি সংগ্রহ করছেন। কোথাওবা পাথর উত্তোলন করে পানির উৎস ধ্বংস করা হচ্ছে। এছাড়া, যেসব ছোট-ছোট খালে অল্প পানি রয়েছে, সেখানেও হাতি দিয়ে গাছ টানার কারণে হাতির মলমূত্রে খালের পানি দূষিত হয়ে ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে।

ক্রামাদি পাড়া, দেওয়াই হেডম্যান পাড়া, যামিনী পাড়া, ম্রোলং পাড়া,বসন্ত পাড়া, নোয়া পাড়াসহ কমপক্ষে ১১০টি পাড়ায় পানি সংকটটা আরো বেশী বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

ম্রো লং পাড়ার বাসিন্দা হাই প্লেম ম্রো খবর সংযোগ ডটকমকে বলেন, শুষ্ক মৌসুমের সময় পাড়ার নারীদের অন্যান্য কাজ বাদ দিয়ে শুধু নিরাপদ পানি সংগ্রহ করতেই অধিকাংশ সময় ব্যয় করতে হয়। বর্তমানে ২৬ পরিবারের ম্রোলং পাড়ায় প্রতি বছর জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত পানি তীব্র সংকট থাকে। পাড়ার নারীদের পরিবারের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পানির জন্য খুব কষ্ট করতে হয়।

তিনি জানান, ভোরে একবার পানি তুলে ফের সকাল ১০টায় পানি আনতে ঝিরিতে যেতে হচ্ছে। সেখানেও তিন ঘন্টা অপেক্ষা করার পর অল্প পানি পেয়েছেন।

ক্রামাদি পাড়ার প্রবীন ব্যক্তি রাংকোইসা ম্রো (৭১) খবর সংযোগ ডটকমকে বলেন, পানির অভাবে দুই থেকে তিন মাস পর্যন্ত নিয়মিত গোসল করা যায় না। সুপেয় পানির জন্য অনেক দূরে যেতে হয়। যারা কাজে যান তারা যেখানেই পানি পান, সেখানে গোসল করে বাড়ীতে ফেরেন। আর নারীরা জুমের কাজে যাওয়ার সময় ময়লা কাপড় থাকলে সাথে করে নিয়ে যান। যেখানে সামান্য পানি পান সেখানেই কাপড় ধুয়ে থাকেন। এইভাবে শুষ্ক মৌসুমে ম্রো পাড়াবাসীর জীবন চলছে

তিনি বলেন, এই অবস্থা চলতে থাকলে পানির সংকটের কারণে এখান থেকে অন্য জায়গায় চলে যেতে হবে।

সুয়ালক ইউনিয়নের আমতলী মারমা পাড়ার কারবারী মংপ্রু সাইন মারমা খবর সংযোগ ডটকমকে বলেন, পাড়ায় তাদের ১৫০ পরিবার, তঞ্চঙ্গ্যা আমতলী পাড়া মাঝের পাড়া, হেডম্যান পাড়াসহ ৫ শত পরিবার শুষ্ক মৌসুমে সুয়ালক খালের উপর নির্ভরশীল। সুয়ালক খালের পাড়ে পাত কুয়া তৈরী করে সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করে পানি পান করতে হয়। দ্বিতীয় আর কোনো উপায় নেই।

বাধ্য হয়ে শিশু,যুব, বয়স্ক দৈনিক ৪-৫ বার পাত কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করে থাকে বলে জানান তিনি ।

বান্দরবান ম্রো জনগোষ্ঠীর লেখক ও গবেষক ইয়াং ঙান ম্রো খবর সংযোগ ডটকমকে বলেন, বনাঞ্চল ধ্বংস, ঝিরির পাথর উত্তোলন করে পানির উৎস ধ্বংস করার কারণে প্রতিবছর চিম্বুক এলাকার প্রায় ১১০টি পাড়ার ম্রো সম্প্রদায় বিশুদ্ধ পানির সংকটে থাকেন। দুর্গম এলাকার অন্যান্য সকল সম্প্রদায়ের বসবাসকারীরাও পানির সংকটে থাকেন। সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকার কারণে প্রতিবছর জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত চিম্বুক এলাকাসহ দুর্গম আদিবাসী পাড়াগুলো বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটে থাকে।

তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এভাবে চলতে থাকলে আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্য শুধু পানির অভাবে ম্রো জনগোষ্ঠী চিম্বুক -নীলগিরি এলাকা থেকে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হবে বলে।

বান্দরবান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী অনুপ কুমার দে খবর সংযোগ ডটকমকে বলেন, পাহাড়ে অপরিকল্পিতভাবে ঝিরির পাশে তথা পানির উৎসের পাশে গাছ কেটে ফেলার কারণে ঝিরি ও ঝর্ণার পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে পানির ভূগর্ভস্থ স্তর ও মাটির অনেক নিচে নেমে যাওয়া পাহাড়ে তাড়াতাড়ি পানি শুকিয়ে যাচ্ছে।

তিনি জানান, পাহাড়ের মাটির গর্ভে পাথর থাকায় গভীর নলকুপ বসানোর মতো সুযোগ নেই। সেখানে রিংওয়েল এবং যেসকল ঝিরিতে শুষ্ক মৌসুমেও পানি থাকে বরাদ্দ সাপেক্ষে জিএফএস পদ্ধতিতে পানি সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। চিম্বুক এলাকায়ও ম্রোসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য নিরাপদ পানির ব্যবস্থা কার্যক্রম চলমান রয়েছে।