অবৈধভাবে জমি দখল, চাঁদাবাজি, ভয়ভীতি প্রদর্শন, মাদক ব্যবসা, গরুর হাটের টেন্ডারবাজি, অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ দিয়ে বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট ক্রয়, নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠান খুলে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তরের অভিযোগে ২০১৯ সালের সুদ্ধি অভিযানে গ্রেফতার হয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব। সেবার আইনের জালে রাজীব আটকা পড়লেও বেঁচে যায় রাজীবের সব অপকর্মের প্রধান সঙ্গী মনিরুজ্জামান মনির।

মনিরের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ একাধিক জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশ পেলেও এখনো তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় ক্ষোভ এবং শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ভুক্তভুগি পরিবারগুলো। রাজীবের গ্রেপ্তারের পর কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকলেও আবারো দখলদারি ও চাঁদাবাজিতে নেমেছে এই ভূমিদস্যু। তবে এরই মাঝে কথিত যুবলীগ নেতা থেকে আদাবর থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদ বাগিয়ে নিয়ে এবার তিনি আরও শক্তি সঞ্চয় করে যখন-তখন সাধারণ মানুষের জমি-বাড়ি দখল করার নেশায় মেতেছেন। মনিরের চাঁদাবাজি এবং দখলদারিত্বে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন এলাকাবাসী।

সাম্প্রতিককালে ঢাকা উদ্যানের বাসিন্দা কে এম মোস্তফা নাজিম তার নিজ জমিতে ৬ তলা বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করলে মনিরের সন্ত্রাসী বাহিনী মোটা অংকের চাঁদা দাবী করে। চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে কাজ বন্ধ করে দিয়ে পরিবারসহ প্রাণনাশের হুমকি দেয়। এ ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানার ওসির কাছে লিখিত অভিযোগ দিতে গেলে ওসি কোন কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়নি বলে জানান ভুক্তভোগী নাজিম। সম্পত্তি এবং জীবন রক্ষার কোনো উপায় না পেয়ে মনিরুজ্জামান মনিরের বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেছেন তিনি।

ভুক্তভোগী মোস্তফা নাজিম বলেন, ২০০৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর ঢাকা উদ্যানের সি- ব্লকে ১নং সড়কের ২নং প্লটে ২.২৫ কাঠা জমি ক্রয় করে গত ১৭ বছর ধরে বসবাস করছি। বাড়ির বিদ্যুৎ বিল , পানি ও হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়মিত পরিশোধ করে আসছি।

ঢাকা উদ্যানে মনিরের বাংলোতে রয়েছে টর্চার সেল। মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর স্থানীয় বাসিন্দা জসিম উদ্দীনকে অপহরণ করে মনিরের বাংলোতে আটকে রেখে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। জসিম ১০লাখ টাকা মুক্তিপণের সংবাদ জানায় স্ত্রীকে। জসিমের স্ত্রী রেবু বেগম অপহরণের বিষয়টি মোহাম্মদপুর থানাকে অবগত করলে থানা পুলিশ মনিরুজ্জামান মনিরের বাংলো থেকে গুরুতর জখম অবস্থায় জসিমকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি করে।

এরপর ২০১৭ সালে দখলদারিত্ব বাড়াতে গেলে কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীবের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে গুলিবিনিময় হয় ভূমি দস্যু মনিরুজ্জামান মনির বাহিনীর সাথে। পরে সমঝোতার মাধ্যমে দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরপর তারা দুজন একযোগে বেড়িবাঁধ এলাকায় জমি দখলে নামে। এভাবেই কাউন্সিলর রাজীব তুরাগ নদের জমি দখল করে শতাধিক প্লটের মালিক হন। গ্রেফতারের পর রিমান্ডের দ্বিতীয় দিনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে এ তথ্য দিয়েছিলেন রাজীব।

তুরাগ তীর ছাড়াও বিগত বছরে ঢাকা উদ্যান, চন্দ্রিমা হাউজিং, তুরাগ হাউজিং, চাঁদ উদ্যান, একতা হাউজিং, রাজধানী হাউজিং, নবীনগর হাউজিং, গ্রিন সিটিসহ ১০টি হাউজিং প্রতিষ্ঠানের বেশকিছু প্লট দখল করেছিলেন কমিশনার রাজীব। আর এই দখলে রাজীবের প্রধান সঙ্গী ছিলেন মনির। বিআইডব্লিউটিএ তুরাগ নদের দুই পাড়ে অভিযান চালালে এ সময় মনিরুজ্জামানের একটি আলিশান বাংলো ও রাজীবের একটি বাড়ি উচ্ছেদ করা হয়। সূত্র জানায়, ঢাকা উদ্যানের ডি-ব্লকের সাড়ে ৬ কাঠার ৫৪ নম্বর প্লটটি মনিরুজ্জামান মনির দখল করে দোতলা বাড়ি নির্মাণ করেন। কমিশনার রাজীব জেলে গেলেও ধরা ছোয়ার বাইরে রয়ে গেছে ভূমি দস্যু মনিরুজ্জামান মনির।

মনিরের চাঁদাবাজির শিকার হন বছিলার স্থানীয় বাসিন্দা ইটভাটা ব্যবসায়ী বরকত উল্লাহ। জানা গেছে ইট, বালু, পাথর ও সিমেন্টের গদিঘরের কর্মচারীকে হুমকি দেয়ায় মনিরের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় জিডি করেন গদিঘরের মালিক বরকত উল্লাহ।

এর আগে মোহাম্মদপুর, আদাবর, ঢাকা উদ্যানসহ বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি, বাড়ি ও জমি দখলসহসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগে মনিরের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় বেশ কয়েকটি মামলা করে ভুক্তভোগীরা। গত বছর সেপ্টেম্বরে বাড়ি দখল ও প্রাণনাশের হুমকি দেয়ায় মো. বিল্লাল হোসেন ও হাজী ইকবাল হোসেন থানায় পৃথক মামলা ও সাধারণ ডায়েরি করেন। ২০১৫ সালে মনিরের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মোহাম্মদপুর ঢাকা উদ্যান ইট বালু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতিতে ব্যাপক ভাংচুর ও লুট পাট করে। একই সময়ে সেখানে অবস্থিত ৮টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের গদি ভাংচুর করা হয়। এসব গদিতে প্রায় ৪০ জন ব্যবসায়ী ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল।

এছাড়াও ২০১৬ সালে একই কায়দায় আজহার এন্টারপ্রাইজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভূয়া নিলামের কাগজ দেখিয়ে সন্ত্রাসী লোকজন দিয়ে বেশ কয়েক ট্রাক ইট বালু সরিয়ে নেয় মনির। দীর্ঘদিন যাবৎ এতো এতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার পরেও আইনের আওতায় না আসায় বিস্মিত হয়েছেন এলাকাবাসী। কোনো কিনারা না পেয়ে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো এবার দপ্তরে দপ্তরে ছুটছেন জীবন ও সম্পত্তি রক্ষায়। সূত্র: ইত্তেফাক