রেফায়েত উল্যাহ রুপক: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি)১৯তম উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক আবু তাহেরকে নিয়োগ দেওয়ার মধ্যদিয়ে শেষ হয় অধ্যাপক শিরীণ অধ্যায়। দায়িত্ব ছাড়লেও আলোচনা-সমালোচনা পিছু ছাড়েননি তার। সর্বশেষ কার্যদিবসে প্রায় অর্ধ-শত নিয়োগ দিয়ে আবারও খবরের শিরোনাম হয়েছেন।

চার বছরের মেয়াদে অন্তত ৫ শত শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন আর এসব নিয়োগে বিপুল পরিমাণ আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরি কমিশন (ইউজিসি) কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় বিধিমালা— কোনো কিছুরই ধার ধারেননি তিনি। ২০২৩ সালের ৩ নভেম্বর অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের উপাচার্য হিসেবে ৪ বছর মেয়াদ পূর্ণ হয়। এসব নিয়োগ ও অনিয়মের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির তীব্র আন্দোলনেও নিয়োগ থেকে বিরত থাকেননি তিনি।

দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে- উচ্চমান সহকারী, নিম্নমান সহকারী, ঊর্ধ্বতন সহকারী, নিরাপত্তা প্রহরী, অফিস পিয়ন, বুক বাইন্ডার, কম্পিউটার ল্যাব সহকারী, ভোজনালয় সহকারী, পেশ ইমাম, ঝাড়ুদার এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে ৬ মাসের জন্য এসব নিয়োগ দিয়ে যান তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী নিয়োগের জন্য অনুসরণ করতে হয় বেশ কিছু নিয়ম। এর মধ্যে শূন্য পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, প্রার্থীদের আবেদন যাচাই, মৌখিক অথবা ব্যবহারিক পরীক্ষা, উত্তীর্ণ প্রার্থীদের নিয়োগের সুপারিশের পর বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট যাচাই-বাছাই শেষে নিয়োগের অনুমোদন দেয়। অথচ অধ্যাপক শিরীণ আখতার অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দায়িত্বের শেষদিন কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই দিয়েছেন কয়েক ডজন নিয়োগ।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত তিন মাসে বিধি বহির্ভূতভাবে শতাধিক নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। এসব নিয়োগে রয়েছে বড় আকারের দেনদরবার। চট্টগ্রামের স্থানীয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতারা এসব নিয়োগে প্রাধান্য পেয়েছেন।

এর আগে ২০২২ সালের ৫ মার্চ চবির ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের বিতর্কিত নিয়োগ বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ সিন্ডিকেট। সেসময় শিক্ষক নিয়োগে লবিংয়ের ৫টি ফোনালাপ ফাঁস হয়। যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মচারীকে বলতে শোনা যায়- শিক্ষক পদে ১৬ লাখ, তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী পদে ১২ লাখ এবং চতুর্থ কর্মচারী পদে ৮ লাখ টাকা লাগবে নিয়োগ পেতে।

এছাড়া চট্টগ্রামের হলে ১৬ লাখ এবং চট্টগ্রামের বাইরের হলে ২০ লাখ টাকা লাগে শিক্ষক হতে। এমন চাঞ্চল্যকর অডিও ফাঁস হওয়ার পরে ফার্সি বিভাগের নিয়োগটি বাতিল হলেও এরপরও থেমে ছিলো না নিয়োগ-বাণিজ্য। ২০২২ সালের ৬ আগস্ট আরও দুটি ফোনালাপ ফাঁস হয়, এতে দেখা যায় নিম্নমান সহকারী পদের কর্মচারী মানিক চন্দ্র দাস নিজেকে সেকশন অফিসার পরিচয় দিয়ে তিন চাকরি প্রার্থীর কাছ থেকে ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা আদায় করেছেন।

এসব ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল নিয়োগে স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। যদিও ২০১৮ সাল থেকে দৈনিক মজুরি কিংবা অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ বন্ধ রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নির্দেশনা দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।

২০১৯ সালের ৪ নভেম্বরে অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান। শিরীণ আখতারের সময়ে সিন্ডিকেটের অনুমোদনে ১৩০ জন শিক্ষক এবং ২৩৮ জন কর্মচারী নিয়োগে পেয়েছেন। অপরদিকে কোনোপ্রকার বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ১১৫ জন এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ৫৭ জন। সর্বমোট ৫৪০ জন শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে গেছেন অধ্যাপক শিরীণ আখতার।

এ বিষয়ে জানতে অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন কেটে দেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কেএম নূর আহমদকে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। তার থেকেও কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ড. নঈম উদ্দিন হাছান আওরঙ্গজেব চৌধুরী বলেন, ‘তিনি হয়তো উনার ক্ষমতাবলে এটা করতে পারেন। কিন্তু এটা সিন্ডিকেট অনুমোদন করে না। এই নিয়োগে একটা প্রক্রিয়া থাকা জরুরি। কারণ, এখান থেকে প্রশাসনের অনেক ওপরে যাওয়ার সুযোগ আছে। সুতরাং এই নিয়োগে স্বচ্ছতা থাকা দরকার।