বলা হয়ে থাকে, পাকিস্তানের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক দল হচ্ছে সে দেশের সেনাবাহিনী। পাকিস্তানি লেখকরাই বলে থাকেন, নিজ দেশ কয়েকবার জয় করতে পারলেও পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতের সঙ্গে সব কটি যুদ্ধেই পরাজিত হয়েছে। নিজ দেশের মানুষকে পরাজিত করে তারা বারবার ক্ষমতা দখল করেছে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসে দিন বদলে গেছে।

সামরিক শাসন ও সরাসরি সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এখন আর গ্রহণযোগ্যতা পায় না। তাই পাকিস্তানের সামরিকতন্ত্রও কৌশল পাল্টিয়েছে। তারা এখন আর সরাসরি ক্ষমতা দখল করছে না। তবে ক্ষমতায় না বসেও সব ক্ষমতার মালিক থাকার জবরদস্ত একটা কৌশল তারা বের করেছে।

এই কৌশলের বড় এক অস্ত্র পাকিস্তানের মোল্লাতন্ত্র। যখনই কোনো প্রধানমন্ত্রী ও সরকার সেনা কর্তৃত্বের বাইরে গিয়ে স্বাধীনভাবে কিছু করতে চেয়েছে, তখনই মিলিটারির ইশারায় কট্টর ইসলামিস্ট দলগুলো ওই সরকারকে ইসলামের দুশমন ও হিন্দু ভারতের দালাল হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং পদত্যাগের দাবিতে মাঠে নেমে রাজপথ দখলে নিয়ে দিনের পর দিন সব কিছু অচল করে দেয়। আর সেই অজুহাতে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালত অথবা প্রেসিডেন্টের হস্তক্ষেপে সরকারের পতন ঘটে। এ জন্যই পাকিস্তানি লেখকরা বলে থাকেন, মোল্লা আর মিলিটারির কবলে পড়ে রাষ্ট্র, রাজনীতি, ধর্ম—সবই শেষ হয়ে গেল।

তাই পাকিস্তানের পণ্ডিত ব্যক্তিরাই পাকিস্তানকে আর স্বাভাবিক রাষ্ট্র মনে করেন না, অস্বাভাবিক রাষ্ট্র মনে করেন। পাকিস্তানই পৃথিবীর একমাত্র রাষ্ট্র, যেখানে ৭৬ বছরের মধ্যে কোনো প্রধানমন্ত্রীই পূর্ণ মেয়াদ ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। পাকিস্তানই একমাত্র রাষ্ট্র, যেখানে প্রতিরক্ষা, সামরিক ও নিরাপত্তা নীতিসহ বৈদেশিক সম্পর্কের বিষয়ে পূর্ণ কর্তৃত্ব থাকে সেনাবাহিনীর ও সেনা গোয়েন্দা সংস্থার হাতে। পাকিস্তানই একমাত্র রাষ্ট্র, যার সেনাপ্রধান সরকার ও প্রধানমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিকভাবে না জানিয়ে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে পারেন। গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই কত ক্ষমতা রাখে তার একটি ছোট উদাহরণ দিই।

পিপলস পার্টির আসিফ আলী জারদারি তখন প্রেসিডেন্ট। রাষ্ট্রীয় সফরে যুক্তরাষ্ট্রে যাবেন। অনেকেই ধারণা করে, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আইএসআইকে যদি সেনা নিয়ন্ত্রণ থেকে বের করে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেন, তাহলে জারদারির গ্রহণযোগ্যতা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনেক বৃদ্ধি পাবে। যুক্তরাষ্ট্র সফর শুরুর এক সপ্তাহ আগে প্রেসিডেন্ট জারদারি আদেশ জারি করেন এই মর্মে যে এখন থেকে আইএসআই প্রেসিডেন্ট দপ্তরের অধীনে কাজ করবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাওয়ার আগের দিন ওই আদেশ প্রেসিডেন্টকে বাতিল করতে হয়। এহেন পাকিস্তানে সম্প্রতি ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন ও তার ফলকে কেন্দ্র করে নতুন সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
পাকিস্তানের সামরিকতন্ত্র কি এবার পরাজিত হবেরাষ্ট্র ও রাজনীতির ওপর সামরিক বাহিনীর সর্বময় কর্তৃত্ব এবার নতুন করে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। পাকিস্তানের জনগণ, নাকি বরাবরের মতো এবারও সামরিক বাহিনীর জয় হবে, সেসব নিয়েই এখন চলছে বহু রকমের বাহাস। প্রাসঙ্গিকতার জন্য একটু পেছনে তাকাই। ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের রহস্যজনক হত্যাকাণ্ড এবং ১৯৫৩ সালে তৎকালীন সেনাপ্রধান আইয়ুব খান যখন একই সঙ্গে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হলেন, তখনই পাকিস্তানের আজকের পরিণতি নির্ধারিত হয়ে যায়। সেই পথ ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে সামরিক শাসন জারি, মোল্লা-মিলিটারির হরিহর আত্মার আঁতাত প্রতিষ্ঠা এবং বৃহত্তর জনমানুষকে দাবিয়ে রাখার জন্য ইসলাম রক্ষা আর হিন্দু ভারত চিরশত্রু—এই মন্ত্রে মাতিয়ে রেখে সামরিক বাহিনী প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সব রাষ্ট্রক্ষমতার মালিক হয়ে সর্বত্র ছড়ি ঘোরাচ্ছে। এর বিপক্ষে কেউ কথা বললেই তাদের ইসলামের শত্রু ও ভারতের দালাল বলা হয়, যে কথা লেখার শুরুতে একবার উল্লেখ করেছি। এতে সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার কেবলই পেছনে গেছে এবং সেই পথ ধরেই স্বাধীনতার মাত্র ২৩ বছরের মাথায় পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত হয়ে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে এবং অবশিষ্ট অংশ বর্তমান পাকিস্তান অস্বাভাবিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ‘পাকিস্তান বিটুইন মস্ক অ্যান্ড মিলিটারি’ গ্রন্থে হুসেন হাক্কানী তথ্য-উপাত্তসহ বিস্তর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন, অস্বাভাবিক রাষ্ট্র হওয়ার জন্য পাকিস্তানের মোল্লা-মিলিটারি চক্রের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার অশুভ আঁতাতই প্রধানত দায়ী। ইসলাম রক্ষার স্লোগান দিয়ে মিলিটারির লাভ চাইল্ড হিসেবে পরিচিত ইমরান খান সেনা গোয়েন্দা সংস্থার নির্ধারিত ছক মোতাবেক অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে ২০১৮ সালে নিজ দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতেই সামরিক বাহিনীর ইশারায়ই ২০২২ সালের ৯ এপ্রিল ক্ষমতাচ্যুত হন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে তেল-জলের মতো সম্পর্কের দুই দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ) ও পিপলস পার্টি মিলে অন্য কিছু ইসলামিস্ট দলকে নিয়ে ১৬ মাস ক্ষমতায় থাকার পর গত ৮ ফেব্রুয়ারি নতুন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

নির্বাচনটি হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। এটি এখন স্পষ্ট এবং সবারই ধারণা, সেনাবাহিনী, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন মিলেমিশে ইমরান খান ও পিটিআইকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যত রকম কলাকৌশল করা যায়, তার সবই করা হয়েছে। কিন্তু তার পরও নির্বাচনে মানুষ ভোটের মাধ্যমে যে মতামত প্রকাশ করেছে বলে সবাই মনে করছে, তাতে এবার নেপথ্যের খেলোয়াড় মিলিটারির সব কৌশলই ব্যর্থ হয়েছে, যদিও ঘোষিত ফল যা প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে আপাতত ইমরান খানকে ক্ষমতার বাইরে রাখার একটা ব্যবস্থা এখনো আছে। নির্বাচনের সময় ইমরান খানের দল পিটিআইকে নিষিদ্ধ করা হয়। তাদের নির্বাচনী প্রতীক ক্রিকেট ব্যাট বাতিল করা হয়। ইমরান খানকে ১৪ বছরের জেল দিয়ে আটকিয়ে রাখা হয়। দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা, জেল-জরিমানাসহ বাড়িতে বাড়িতে পুলিশি অভিযান চালানো হয়। ভোটার উপস্থিতি যাতে কম হয় তার জন্য ভোটের দিন ইন্টারনেট ও মোবাইল সার্ভিস বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু ৮ ফেব্রুয়ারি ভোটগ্রহণ শেষে গণনা শুরু হতেই দেখা যায় ২৬৬ নির্বাচনী আসনের মধ্যে ১৮০ আসনে পিটিআইনের পক্ষ থেকে যাঁরা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করছেন, তাঁরা এগিয়ে আছেন। হঠাৎ করেই ভোটগণনা ও ফল প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়।

বাংলাদেশের কিছু মানুষ, যারা পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদাহরণ দেয়, তারা এবার নিশ্চয়ই বুঝেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কখনোই গণতান্ত্রিক রাজনীতির যে সংকট তার সমাধান নয়। একজন নির্বাচন কমিশনার দু-তিন দিন আগে মাঠে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছেন। বলেছেন, পাঞ্জাবের লাহোরে ১৮টি আসনে পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীকে পরাজিত ঘোষণা করতে তিনি বাধ্য হয়েছেন, যদিও তাঁরা অনেক ভোটে এগিয়েছিলেন। আগুনে ঘি ঢালার মতো অবস্থা। ৪৮ ঘণ্টার মাথায় চূড়ান্ত ফল ঘোষণায় দেখা যায়, এত কিছু করার পরও পিটিআইয়ের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এককভাবে সর্বোচ্চ আসনে জয়ী হয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে সামরিক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বৃহত্তর মানুষের একটা ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে। তবে ঘোষিত ফল অনুযায়ী যেহেতু কোনো দলই এককভাবে সরকার গঠনের জন্য নির্বাচনী আসনের মধ্যে প্রয়োজনীয় ১৩৪ আসন পায়নি, তাই সরকার গঠন ও তার স্থায়িত্ব মূলত সামরিক বাহিনীর হাতে থাকলেও মুসলিম লীগ ও পিপলস পার্টি নিজ নিজ রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় কখন কোন দিকে কী করবে, সেটাও সরকার টিকে থাকা অথবা না থাকার ব্যাপারে বড় এক ফ্যাক্টর হয়ে থাকবে। এই দুই দলের এক দল যদি তলে তলে পিটিআইয়ের সঙ্গে হাত মেলায়, তাহলে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হবে। সে কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, এবার সামরিক বাহিনী তাদের মিশনে কতখানি সফল হতে পারবে।

মুসলিম লীগ ও পিপলস পার্টি পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী শুধু নয়, একে অপরের রাজনৈতিক শত্রু। এই শত্রুতার সুযোগেই এর আগে পিপলস পার্টির প্রয়াত নেতা বেনজির ভুট্টো মেয়াদপূর্তির আগে দুইবার ও মুসলিম লীগের নওয়াজ শরিফ তিনবার সামরিক বাহিনীর ইশারায় ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। দুই দলই একে অপরকে ঘায়েল করার জন্য সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আপস করেছে। ইমরান খানও সামরিক বাহিনীর আশীর্বাদে ২০১৮ সালের তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হন। অর্থাৎ তিনটি বড় দলই একে অপরকে ল্যাঙ মারার জন্য সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আপস করেছে। এবারের প্রেক্ষাপট ও চলমান পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। সামরিক বাহিনী সব কলাকৌশল অবলম্বন করেও গণজাগরণ ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। পাকিস্তানের মিডিয়াসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও বৈশ্বিক মিডিয়ার কাছে স্পষ্টভাবেই ধরা পড়েছে, নির্বাচনের ভোটগণনায় ভয়ানক কারচুপি হয়েছে। ফল প্রকাশের ১২ দিনের মাথায় এই লেখাটি যখন শেষ করছি, তখনো নতুন কোনো সরকার গঠিত হয়নি। সামরিক বাহিনী নেপথ্য থেকে অনেক চেষ্টা করেও পিটিআই সমর্থিত জয়ী হওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্য থেকে দু-একজন ছাড়া বড় ধরনের দলছুটের ঘটনা ঘটাতে পারেনি। বেশির ভাগ বিশ্লেষকের ধারণা, সামরিক বাহিনীর নেপথ্যের ভূমিকার কারণে আপাতত হয়তো মুসলিম লীগ ও পিপলস পার্টির মধ্যে একটা সমঝোতা হবে। তবে সেটা কোয়ালিশন সরকার হবে, নাকি পিপলস পার্টির সমর্থনে মুসলিম লীগ সংখ্যালঘু সরকার গঠন করবে, সেটা হয়তো কয়েক দিনের মধ্যেই জানা যাবে। তবে যেটাই হোক, সে সরকার যে খুবই দুর্বল ও ভঙ্গুর হবে, তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। আর পাকিস্তানের চলমান ভঙ্গুর অর্থনীতিকে ঠিক করার জন্য যে রকম কঠিন অজনপ্রিয় সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হবে, সেটা একটা টলটলায়মান সরকারের পক্ষে নেওয়া সম্ভব হবে না। তাই দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থা যতই বাড়বে, মানুষ ততই সরকারের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠবে। সেই সুযোগটা ইমরান খানের পিটিআই কতখানি নিতে পারবে তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। তবে পাকিস্তানের ইতিহাসে এবারই প্রথম যে ২০২৩ সালের জুন মাসে পিটিআইয়ের সমর্থকরা সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর ও একজন কোর কমান্ডারের বাড়িতে সরাসরি আক্রমণ চালিয়েছে। অনেকেই বলছে, ওটা ছিল সামরিকতন্ত্রের কবল থেকে পাকিস্তানকে মুক্ত করার যে যাত্রা, তার শুরু। ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন ঘিরে এরই মধ্যে যা ঘটে গেছে, তার সব কিছু ওই যাত্রাকে কি আরো এগিয়ে নেবে, নাকি সামরিকতন্ত্র আরো জেঁকে বসবে, সেটাই হবে আগামী দিনে দেখার বিষয়।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক