আব্দুল্লাহ সম্প্রতি যখন পাকিস্তান ও ভারত সফর করলেন, তখন মনে হয়েছে যে, তালেবানদের সাথে আলোচনারত আফগান পিস কাউন্সিলের প্রধান দুই আঞ্চলিক খেলোয়াড়ের সাথে লেনদেনের মধ্যে একটা সমন্বয় করছেন। কিন্তু সফরটি বুঝিয়ে দিয়েছে যে, এটা শুধুমাত্র ‘শান্তি সমন্বয়ের’ চেয়েও অনেক বেশি কিছু ছিল। সাউথ এশিয়ান মনিটর।

পাকিস্তানে আব্দুল্লাহর সফর ছিল এক দশকের মধ্যে প্রথম। সফরের উদ্দেশ্য ছিল আফগানিস্তানে একটা রাজনৈতিক ভারসাম্যপূর্ণ সিস্টেম ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে পাকিস্তানকে রাজি করানো, এবং সেখানে যাতে তালেবান-আধিপত্যের সিস্টেম চালু না হয়, সেটা নিশ্চিত করা। অন্যভাবে বললে, তালেবানদের পক্ষে যেখানে পাকিস্তানের সমর্থন রয়েছে, সেখানে ক্ষমতাসীন আফগান অভিজাত শ্রেণী নয়াদিল্লীর সাথে তাদের অতীত সম্পর্কটা পুঁজি করে পাকিস্তান-সমর্থিত তালেবানদের বিপরীতে একটা পাল্টা-ভারসাম্য গড়তে চেয়েছে।

মোদি সরকার কাবুলকে কতদূর সাহায্য করতে পারবে, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। আফগানিস্তানে একটা জোরালো অবস্থান না থাকলে ভারত কাবুলকে সহায়তা করতে পারবে না। চাবাহার বন্দরের মতো ইরানের গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক অবস্থানে ভারতের অবস্থান হারিয়ে যাওয়ার কারণে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা ভারতের দারুণভাবে কমে গেছে।

ইরান যদি ভারতের জন্য আফগানিস্তানে প্রবেশের দ্বার হয়ে থাকে, তাহলে এই পথটা এখন আর খোলা নেই, কারণ চাবাহার আর ফারজাদ-বি প্রকল্পের ব্যাপারে ভারতের অশোভন আচরণের কারণে তাদের সাথে ইরানের দূরত্ব বেড়েই চলেছে। ফারজাদ-বি প্রকল্পটি হারানো ভারতের জন্য বড় ধরনের আঘাত, ইরানের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বাইরের যেটার প্রভাব ভারতের উপর পড়বে।

এটা আফগানিস্তানে ভারতের প্রভাব বিস্তারের সক্ষমতাকে পঙ্গু করে দেবে এবং আফগানিস্তানের সাথে বাণিজ্যের জন্য পাকিস্তানের উপরও তাদের নির্ভরতাও আরও বাড়তে পারে। ভারতীয় মিডিয়াগুলোতে এরই মধ্যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে যে, ভারতের বাণিজ্যের চালানগুলো ওয়াগা সীমান্তে ‘মারাত্মক সমস্যার’ মুখে পড়ছে। আফগানিস্তানে ভারত যে কোন আগ্রাসী পদক্ষেপ নিলে ইসলামাবাদ সীমান্তে তাদের সূতায় টান দেবে।

আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহ এবং আফগান ক্ষমতাসীন শ্রেণীর বাকি শাসকদের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যাতে ভারতীয়রা আফগানিস্তানে চুপচাপ থাকে, যতক্ষণ না একটা শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হচ্ছে।

আব্দুল্লাহর ভারত সফরের উদ্দেশ্য তাই এটা ছিল না, যাতে নয়াদিল্লীকে তাদের তালেবান নীতি পরিবর্তনের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা যায়। বরং ভারত যাতে তৎপরতা সীমিত রাখে, সেটাই ছিল উদ্দেশ্য। কাবুল ও যুক্তরাষ্ট্র (এবং নিঃসন্দেহে ভারতও) জানে যে আফগানিস্তানে কার্ডগুলো মূলত পাকিস্তানের হাতে রয়েছে।

আফগানিস্তান শান্তি প্রক্রিয়ায় ভারতের উচ্চ পর্যায়ের সংশ্লিষ্টতা থাকলে সেটা কাবুলের জন্য সমস্যা তৈরি করবে। কাবুল ভারতের সমর্থন চায় ঠিক, কিন্তু তারা চায় যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান-তালেবান জোটের সাথে ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে সক্রিয় হোক ভারত।

এখন কাবুলের লক্ষ্য হলো ইসলামাবাদ আর বেইজিংয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ লিয়াজোঁ বজায় রাখা। এই দেশগুলোর সাথে তার যোগাযোগ রাখতে চায় যাতে শান্তি প্রক্রিয়ায় টিকে থাকার ব্যাপারে তালেবানদের উপর চাপ বজায় রাখা যায়, যে কাজটা ভারত কোনভাবেই করতে পারবে না।

কাবুল এটা বুঝতে পারছে যে, মার্কিন সেনা প্রত্যাহার অত্যাসন্ন এবং একটা তাদের অনুপস্থিতিতে তালেবানদের সাথে একটা শান্তি চুক্তি ও ক্ষমতা ভাগাভাগির ফর্মুলা না থাকলে তালেবানরা ক্ষমতার দখল নেবে। সে কারণে, তাদের এই মুহূর্তের করণীয় হলো ইসলামাবাদ আর বেইজিংয়ের সাহায্য নিয়ে একটা শান্তি চুক্তিতে পৌঁছানো। এটা দেখা গেছে যে, ইসলামাবাদ ছাড়াও বেইজিং তালেবানদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করছে এবং আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং আফগান মাটিতে চীনা জঙ্গি গ্রুপগুলোকে তৎপরতা চালাতে না দেয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে তালেবানদেরকে উন্নয়ন সহায়তা ও বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বেইজিং।

আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহ সে কারণে এটা নিশ্চিত করতে চেয়েছেন যে, কাবুল আর তালেবানদের মধ্যে যখন শান্তি চুক্তি হয়ে যাবে, নয়াদিল্লী যেন তখন তাদের ভূমিকা রাখে।

ভারত সফরকালে দেয়া এক সাক্ষাতকারে আব্দুল্লাহ নিশ্চিত করেন যে, ভারতীয় নেতারা তাকে আশ্বস্ত করেছেন যে, আফগান জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য যে কোন সমাধানকে তারা সমর্থন দিবেন।

তৎপরতা সীমিত রাখলে সেটা ভারতের জন্যও ভালো। এটা খুবই স্পষ্ট হয়ে কাবুলের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য কোন দেশই আফগান শান্তি প্রক্রিয়ায় ভারতের আরও গভীর সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখায়নি।

পাকিস্তান এরই মধ্যে বিশ্বের কাছে এটা তুলে ধরতে শুরু করেছে যে, আফগানিস্তানে ভারতের ভূমিকা ও উপস্থিতি বাড়লে কিভাবে তারা আফগানিস্তানকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে। পাকিস্তান যদিও সীমান্তে বেড়া দেয়া শুরু করেছে, কিন্তু এতে কোন সন্দেহ নেই যে, পাকিস্তান তার উঠানে যে কোন ধরনের ভারতীয় তৎপরতাকে চরম অপছন্দ করে।

ভারতের অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে পাকিস্তানের জোরালো প্রতিক্রিয়ার কারণে পাকিস্তান আফগানিস্তানের যুদ্ধ-পরবর্তী যুগে তালেবানদের ভূমিকা জোরালো রাখার জন্য চাপ দেবে। এটা সুস্পষ্ট যে, এই ধরনের চাপ তালেবানদের বিরুদ্ধে কাবুলের অবস্থানকে আরও দুর্বল করে দেবে। সে কারণে, আলোচনার এই পর্যায়ে এমনকি কাবুলও শান্তি প্রক্রিয়ায় ভারতকে জড়িয়ে পাকিস্তানের সমর্থন হারানোর ঝুঁকি নিতে পারে না।

সম্ভবত আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহর বার্তাটা দিল্লি বুঝতে পেরেছে, এবং সে কারণেই তার সফরের পর দুই দেশের পক্ষ থেকে কোন যৌথ বিবৃতি দেয়া হয়নি। তার বদলে ভারতের মন্ত্রীরা টুইটারে নিজেদের প্রতিক্রিয়া সীমিত রেখেছেন এবং বলেছেন যে, আব্দুল্লাহর সাথে তাদের ‘গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা’ হয়েছে।

লেখক: সালমান রাফি শেখ।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, পাকিস্তান।