করোনাকালের বাজেট নিয়ে যারা টেনশনে, তাদের জন্য কিছু কর সুবিধা আসছে। ফলে কমতে পারে পণ্যমূল্য। একটু স্বস্তির দেখা পাবেন সাধারণ করদাতা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা এবং অন্য ব্যবসায়ীরাও। জানা গেছে, প্রস্তাবিত বাজেটে সাধারণ করদাতাদের জন্য যেমন করমুক্ত আয়সীমা বাড়ছে, তেমনি ব্যবসায়ীদের জন্য কমবে করপোরেট করহার। জরিমানা ছাড়া অপ্রদর্শিত অর্থে কিছুটা সুবিধা দিয়ে বিনিয়োগ চাঙ্গা করতে চায় সরকার। ভ্যাটের হার, আগাম এবং টার্নওভার করও কমছে। শিল্পের কাঁচামালে কর কমিয়ে উৎপাদন খরচ কমানোর চিন্তাও আছে। মাস্ক, ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই) আমদানি ও উৎপাদনে ভ্যাট এবং শুল্ক অব্যাহতি আসছে। ভ্যাট আইনের অসঙ্গতি ও জটিলতা দূরীকরণের নির্দেশনাও থাকছে আসছে বাজেটে।
২০২০-২১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট প্রস্তাবনা আগামী ১১ জুন জাতীয় সংসদে পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। জানা গেছে, এই বাজেটের মাধ্যমে সরকার আগামী অর্থবছর ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা খরচের হিসাব কষেছে। বিপরীতে সরকার আয় করতে চায় ৩ লাখ ৮২ হাজার ১৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরকে আদায় করতে হবে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব। মহামারী করোনাভাইরাসের চলমান অর্থনৈতিক মন্দায় থমকে আছে বাংলাদেশ ও বিশ্ব। স্থবির ব্যবসা-বাণিজ্য। শিল্পের চাকা এখনো ঘুরছে না। বিপর্যয় আমদানি-রপ্তানিতেও। নেই টাকার সরবরাহ। তাই নতুন অর্থবছরে রাজস্ব আয়কে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন সবাই। করোনাভাইরাসের প্রভাব দীর্ঘ হলে রাজস্ব আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, এমন শঙ্কা নিয়েই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আগামী অর্থবছর ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে হবে। পাশাপাশি করবহির্ভূত রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য থাকছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। কর ব্যতীত প্রাপ্তির পরিমাণ হচ্ছে ৩৩ হাজার ৩ কোটি টাকা। তবে করদাতাদের চাপ দিয়ে নয়, বরং কিছুটা ছাড় দিয়েই রাজস্ব আদায় করার দিকনির্দেশনা বাজেটে আসছে।
রাজস্ব বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত এনবিআরের সূত্রগুলো বলছে, এবারের বাজেটের সুফল মিলবে সবার। সে লক্ষ্যে করোনার আঘাতে বিপর্যস্ত সাধারণ মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দিতে পণ্যমূল্য কমানো এবং সহনীয় রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সব ব্যক্তিশ্রেণির করদাতার জন্য করমুক্ত আয়সীমা চার অর্থবছর পর এবারের বাজেটে ৫০ হাজার টাকা বাড়িয়ে তিন লাখ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব আসছে। এর সঙ্গে ৫ থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৭ শতাংশ করপোরেট কর কমানো হতে পারে, যা কার্যকর হবে দুই অর্থবছরে। ফলে বিনিয়োগ চাঙা হওয়ার আশা করছে সরকার। মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় ও আয় কমে যাওয়া এবং মূল্যস্ফীতি- এ তিনে মিলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের অবস্থা শোচনীয়। বিষয়গুলো মাথায় রেখেই বাজেটে নতুন করে কর আরোপ করা হচ্ছে না। বরং করমুক্ত আয়সীমায় ছাড় দেওয়া হচ্ছে।
এনবিআর কর্মকর্তারা আভাস দিয়েছেন, বাজেটে বিনিয়োগ বাড়াতে কর ছাড় দেওয়া হবে। বর্তমানে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগে কর ছাড় রয়েছে। আগামী বাজেটেও তা অব্যাহত থাকবে। আসছে বাজেটে উৎপাদনশীল শিল্প ও আবাসন খাতে কোনো ধরনের জরিমানা ছাড়াই অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ প্রসারিত করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে বৈধভাবে অর্জিত অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ। ফলে আগামী ২ থেকে ৫ বছর অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ থাকতে পারে আসছে বাজেটে। এ অর্থের উৎস নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কোনো প্রশ্ন করবে না এমন আভাসও পাওয়া গেছে। এতে বৈধভাবে অর্জিত অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগে করোনার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে সহায়ক হবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। এ জন্য উৎপাদনশীল খাতে ওই অর্থের বিনিয়োগ ভয়মুক্ত পরিবেশে নিশ্চিত করার নির্দেশনাও বাজেটে চান আবাসনশিল্পের মালিকরা। বর্তমানে শিল্প ও ফ্ল্যাট ক্রয়ের ক্ষেত্রে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। আবাসন, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে এ সুযোগ নেওয়া যায়। পুঁজিবাজারসহ কয়েকটি খাতে এ সুযোগ দেওয়া হতে পারে। মূলত বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্যই এ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
এনবিআর সূত্র বলছে, যে-কেউ অপ্রদর্শিত আয়ের ঘোষণা দিয়ে যে কোনো অঙ্কের অর্থ বৈধ করতে পারবেন। ‘ভলান্টারি ডিসক্লোজড অব ইনকাম’ নামে পরিচিত এই নিয়মটি ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রবর্তন করা হয়। এ সুযোগ নিতে হলে প্রযোজ্য কর হার ও এর সঙ্গে ১০ শতাংশ জরিমানা দিতে হয়। আসছে বাজেটে এ জরিমানা তুলে দেওয়ার প্রস্তাব আসতে পারে। ফলে জরিমানা ছাড়াই শুধু ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের প্রস্তাব থাকতে পারে আসছে বাজেটে। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রশ্ন করবে না এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।
ভ্যাট নিয়ে এনবিআরের কর্তাব্যক্তিদের আভাস হলো, মানুষের আয় কমেছে। তাই মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাটে কিছুটা আইনি ছাড়, হার কমানো, ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশার আলোকে আইনি জটিলতা নিরসন, ফাঁকির পথ বন্ধ করেই কিছু সংস্কারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যে আগাম করে পরিবর্তন আসছে। প্রস্তাবিত বাজেটে আগাম করের দুটি স্তর থাকছে। শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামালের জন্য হবে ৩ শতাংশ। আর যারা বাণিজ্যিকভাবে পণ্য আমদানি করবেন, তাদের জন্য ৫ শতাংশই বহাল থাকছে। কারণ মূলধনী যন্ত্রপাতি বা কাঁচামালের কর কমলে শিল্প উৎপাদন খরচও কমবে। ফলে মানুষ সহনীয় মূল্যে পণ্য কিনতে পারবেন। করোনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছোট ব্যবসায়ীদের কিছুটা ভ্যাট ছাড় দেওয়া হতে পারে। বর্তমানে ৫০ লাখ টাকা থেকে তিন কোটি টাকা পর্যন্ত বছরে লেনদেন বা বিক্রি হলে তারা ১৫ শতাংশের পরিবর্তে ৪ শতাংশ হারে টার্নওভার কর দেন। তাদের জন্য টার্নওভার কর কমিয়ে ৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হচ্ছে। এ প্রস্তাব কার্যকর হলে ব্যবসার খরচ কমবে, যা প্রকারান্তরে ভোক্তারা সুবিধাভোগী হবেন। তাই বাজেটে ভ্যাট হার ও আওতা খুব একটা বাড়ছে না। নজর বেশি সংস্কারে। নতুন আইনে উৎসে কর আদায় ও রেয়াত প্রদানে যেসব অসঙ্গতি আছে, তাতে ব্যাপক সংস্কারের পদক্ষেপ থাকছে। বর্তমানে উৎসে কর ও রেয়াত নেওয়াসহ কয়েকটি ক্ষেত্রে আইনি জটিলতা রয়েছে। এ কারণে হয়রানির শিকার হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। বাজেটে এ ধরনের ১০ থেকে ১২টি ক্ষেত্রে আইনি সংস্কার করার প্রস্তাব করা হবে।
সূত্র বলছে, মহামারী করোনাভাইরাসের হাত থেকে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দিতে চায় সরকার। সেই উদ্যোগ হিসেবে প্রস্তাবিত বাজেটে চিকিৎসা কাজে ব্যবহার হওয়া মাস্ক, ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী আমদানি ও উৎপাদনসহ বেশ কিছু খাতে ভ্যাট ও শুল্ক অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে। তবে তামাকপণ্যের ওপর বরাবরের মতোই কর বাড়বে। সিগারেটের মধ্যম ও নিম্নস্তরে সম্পূরক শুল্ক ৫ থেকে ১০ শতাংশের মতো বাড়তে পারে। ছাড় দেওয়া ভ্যাটের অর্থ এ খাত থেকে পুষিয়ে নিতে চায় এনবিআর। পোশাকশিল্পসহ পুরো রপ্তানি খাতে বিশেষ ছাড় দেওয়া হচ্ছে করোনাকালের এই বাজেটে। কারণ করোনাভাইরাসের প্রভাবে রপ্তানি খাত বিশাল ধাক্কা খেয়েছে। রপ্তানির অন্যতম স্তম্ভ তৈরি পোশাক খাতের অর্ধেকের বেশি কারখানা লে-অফ হয়ে গেছে। আগামী মাস থেকে কর্মী ছাঁটাইয়ের শঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে পোশাক খাতে চার ধরনের প্রণোদনা দেওয়া হয়ে থাকে। এটি যথাক্রমে চার, চার ও দুই শতাংশ। ইউরোপ ও আমেরিকায় তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ১ শতাংশ নগদ সহায়তা দেওয়া হয়ে থাকে। এটি বাড়িয়ে ২ শতাংশ করা হতে পারে। আগামী বাজেটে ওষুধ খাতেও রপ্তানি প্রণোদনা বাড়ানো হতে পারে। বর্তমানে ওষুধ খাত ১০ শতাংশ হারে প্রণোদনা পায়। আগামী বাজেটে এটি বাড়িয়ে ১১-১২ শতাংশ করা হতে পারে। মেডিকেল এবং অপারেশনের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ওষুধ খাতের মতোই প্রণোদনা পাবে। এ ছাড়া চামড়া, পাদুকা, পাটসহ অন্যান্য শিল্পও একই ক্ষতির মুখে পড়েছে। তাই রপ্তানি খাতে বিশেষ ছাড় দেওয়া হতে পারে। তবে ঢালাওভাবে রপ্তানিতে ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন এনবিআর কর্মকর্তারা। আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে কিছু কর ছাড় থাকবে। পাশাপাশি রপ্তানি খাত চাঙ্গা করার জন্য এ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ানো হবে আগামী বাজেটে। রপ্তানি খাতে ভর্তুকি দেওয়া হবে ৬ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। বর্তমানে বিভিন্ন পণ্যে রপ্তানি প্রণোদনা দেওয়া হয়। আগামী বাজেটে প্রণোদনা পাওয়া পণ্যের সংখ্যা বাড়ানো হবে। বাজেট প্রণয়নে জড়িত কর্মকর্তারা আরও আভাস দিয়েছেন, দ্বৈত কর পরিহারের ঘোষণাও আসতে পারে এবারের বাজেটে। নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই করের ওপর কর বা ট্যাক্স অন ট্যাক্স বসানো হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে আমদানি শুল্কের পাশাপাশি অগ্রিম আয়কর দিতে হচ্ছে। এ ছাড়া পণ্য বিক্রির সময়ও পৃথক কর দিতে হয়। এতে ব্যবসায়ীরা অসন্তুষ্ট। এদিকে যারা টাকা একটু ব্যাংক রেখে সারা বছর চলেন, তাদের জন্য সুখবর নেই। আসছে বাজেটে এমন বড় ব্যাংকে বড়লোকদের টাকা রাখার খরচ বাড়তে পারে। বর্তমানে ব্যাংক হিসাবে নির্দিষ্ট সীমার বেশি টাকা থাকলেই বিভিন্ন হারে আবগারি শুল্ক আরোপ করা হয়। বছরে একবারের জন্য হলেও ব্যাংক হিসাবে এক লাখ টাকার বেশি থাকলেই আবগারি শুল্ক দিতে হয়। সর্বোচ্চ শ্রেণিতে আবগারি শুল্কের পরিবর্তন আসতে পারে। ৫ কোটি টাকার বেশি ব্যাংক হিসাবে থাকলে বর্তমানে ২৫ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক আরোপ হয়। এই অতি ধনী শ্রেণির আবগারি শুল্কের পরিমাণ ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে। বর্তমানে ব্যাংক হিসাবে এক লাখ টাকার কম থাকলে আবগারি শুল্ক দিতে হয় না।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন