মহসিন খান: সময় ১:৪৫মিনিট। হঠাৎ পেছন থেকে ডাক। স্যার,যাবেন, স্যার, যাবেন? পেছনে তাকাতেই দেখি, সরল এবং নিষ্পাপ দৃষ্টি আমার পানে। রিকশার হ্যান্ডেল হাতে দাঁড়িয়ে। চোখ পড়তে মুচকি হাসি। কিছু সময়ের জন্য নিজের মধ্যে হারিয়ে যাই এবং কবি জসিম উদ্দীনের সেই রাখাল ছেলের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে। মুচকি হেসে তার রিকশায় চড়ে বসি। তার রিকশায় চলতে চলতে কথা হলো তার সাথে।
তার নাম আবু হানিফ। পিতা: মো:আব্দুল লতিফ। গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানায় তার গ্রামের বাড়ি। তার বড় তিন বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। তার বাবা রিকশা চালান ঢাকার খিলক্ষেতের বিভিন্ন এলাকায়। সে গ্রামে দশম শ্রেণিতে পড়ে । অবসর সময়ে পড়াশোনার পাশাপাশি মানুষের ক্ষেতে কাজ করে এবং স্কুল বন্ধ হলেই পিতাকে সাহায্য করতে চলে আসেন ঢাকায়। হাতে তুলে নেয় রিকশায় হ্যান্ডেল। যতোদিন স্কুল বন্ধ থাকে কিছু টাকা উপার্জন করে অসচ্ছল পরিবারকে সচ্ছল করার চেষ্টা তার।
সকাল হতেই বাবা-ছেলে দুজনেই রিকশা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। দুপুরে সামান্য দুমুঠো খেয়ে নেন কোনো হোটেলে। রাতে থাকে রিকশার গ্যারেজে। সেখানেই সারাদিন রিকশা চালিয়ে পড়েতে বসে সে। যতোক্ষণ শরীরে নিয়ন্ত্রণ রাখা যায় ততোক্ষণ পড়তে থাকে এবং পরে ঘুমিয়ে যায়। সকাল হতে না হতেই আরেকটি দিন, আরেকটি নতুন যুদ্ধক্ষেত্রে বড় হওয়ার প্রত্যয়ে জীবন যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে।
কথা বলার এক পর্যায়ে তার কাছে জানতে চাওয়া হয় এতো কষ্ট করেও পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছো কেনো? তার সরল উক্তি, “পড়াশোনা ছাড়া কি ভাগ্য পরিবর্তন করা সম্ভব?” হাজারো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যে বোধটি জাতিকে বোঝাতে হিমশিম খাচ্ছে,জীবন বাস্তবতায় তার সেই উপলব্ধি। তার কাছে আবারো জানতে চাওয়া হয় তাহলে রিকশা চালাচ্ছে কেনো? তার উক্তি “এখন তো করোনার কারণে স্কুল বন্ধ। রিক্শা চালিয়ে যদি বাবাকে কিছু টাকা দেয়া যায় তাহলে সংসারের একটু ভালো হয়, সংসার ভালো চলে।”
কথা বলতে বলতে তার বাবার সাথে সাক্ষাৎ হয় এবং তাদেরকে বাসায় নিয়ে আসি। কথা হয় তার বাবার সাথে।তিনি জানান, আমার ছেলে অনেক ভদ্র এবং শান্ত। আমি ওকে দিয়ে কাজ করাতে চাইনি। কিন্তু আমি আর্থিকভাবে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত। আমি চাই না বড় হয়ে আমার ছেলে আমার মতো রিকশা চালাক। কিন্তু কী করবো বলেন?এলাকার রাখতে ভরসা পাই না। কারণ এলাকার ছেলেগুলো করোনার সময়ে অনেক অপরাধমূলক কাজে জাড়িয়ে পড়ছে। মাদক আসক্ত হয়ে পড়ছে তারা। এর থেকে রক্ষা করতেই মূলত ছেলেকে নিজের কাছে রাখা। পরিবেশ স্বাভাবিক হলে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে আমি আমার ছেলেকে ভালো করে পড়াতে চাই, ওকে মানুষের মতো মানুষ বানাতে চাই। আমার তো আর তো সম্পত্তি নেই! তাই ছেলের এখন আমাদের সম্পদ।
আবু হানিফ জানায়, সে শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চায়, দেশের সেবা করতে চায়। সে তার পরিবারের অভাব অনটন দূর করে বাবা মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে চায়।
আসলেই কি আবু হানিফ রিকশা চালানোর পাশাপাশি তার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে? পারবে কি তার বৃদ্ধ পিতার স্বপ্ন পূরণ করতে? পারবে কি দেশ এবং সমাজের উপকার করতে? পারবে কি অসচ্ছল এবং বৃদ্ধ মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে?
আজকের এই আবু হানিফদের জন্য দেশের সরকারের কি কোনো দায় নেই? বিত্তবান এবং সমাজপতিরা কি পারে না তাদের দিকে একটু সাহায্যের হাত বাড়াতে? তবে কি আমরা হারিয়ে যেতে দেবো আবু হানিফদের? তবে কি হারিয়ে যাবে আবু হানিফরা!
লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক