হজ্ব আরবী শব্দ। এর অর্থ নিয়ত করা, সংকল্প করা বা ইচ্ছা করা। ইসলামের শরীয়াতের পরিভাষায় নির্দিষ্ট দিনে নিয়তসহ ইহরামরত অবস্থায় আরাফার ময়দানে অবস্থান এবং বায়তুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ করা।
উমরা শব্দের অর্থ হলো পরিদর্শন করা। ইসলামের শরীয়াতের পরিভাষায় ইহরামরত অবস্থায় কাবার চারপাশে তাওয়াফ ও সাফা ও মারওয়া সায়ী করাকে উমরা বলে। হজ্ব ও উমরা ইসলামের অন্যতম একটি নিদর্শন। হজ্ব ইসলামের ৪র্থ স্তম্ভ। জিলহজ্বের ৮ তারিখ থেকে হজ্বের কার্যক্রম শুরু হয়। আর উমরা হজ্বের সময় ব্যতীত বছরের যেকোন সময় আদায় করা যায়। তবে রমজান মাসের আদায়ের অনেক ফযিলত রয়েছে।
★হজ্বের ঐতিহাসিক পটভূমি:
কাবাঘরে সর্বপ্রথম হজ আদায় করেন নবী আদম (আঃ) তারপর নূহ সহ অন্যান্য নবী-রাসূল এ দায়িত্ব পালন করেন। ইব্রাহিম (আ:) এর সময় থেকে হজ ফরজ বা আবশ্যকীয় ইবাদত হিসেবে নির্ধারিত করা হয়। মহান আল্লাহ তায়ালা আদেশে কাবাঘর পুনরায় নির্মাণ করে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) আবু কোবাইস পাহাড়ে দাড়িয়ে হজ্ব ফরজ হওয়ার কথা ঘোষণা করেন।
*কোরানের বর্ণনা:
যখন আমি ইবরাহীম কে বায়তুল্লাহর স্থান ঠিক করে দিয়ে বলেছিলাম যে, আমার সাথে কাউকে শরীক করো না এবং আমার গৃহকে পবিত্র রাখ তাওয়াফকারীদের জন্যে, নামাযে দন্ডায়মানদের জন্যে এবং রুকু-সেজদাকারীদের জন্যে। এবং মানুষের মাঝে হজ্জ্বের ঘোষণা প্রচার কর। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেটে এবং সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে। (সুরা হজ্ব ২৬ ও ২৭)
★হজ্বের গুরুত্ব:
হজ্ব মূলত কায়িক ও আর্থিক উভয়ের সমন্বিত একটি ইবাদত। তাই উভয় দিক থেকে সামর্থ্যবান মুসলিমের উপর হজ্ব পালন করা ফরয। অর্থাৎ হজ্ব আদায়ে সক্ষম এমন শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচাপাতি ও আসবাবপত্রের অতিরিক্ত হজ্বে যাওয়া-আসার ব্যয় এবং হজ্ব আদায়কালীন সাংসারিক ব্যয় নির্বাহে সক্ষম এমন সামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর হজ্ব আদায় করা ফরয। হজ্ব প্রত্যেক মুসলমানের উপর সারা জীবনে একবারই ফরয হয়। একবার ফরয হজ্ব আদায়ের পর পরবর্তী হজ্বগুলো নফল হিসেবে গণ্য হবে।
*এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, আবু হুরায়রা (রা)বর্ণনা করেন, একদা রাসূলুল্লাহ(সঃ) আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। তিনি বলেনঃ হে মানবসকল! আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর হজ্ব ফরয করেছেন। সুতরাং তোমরা হজ্ব করো। এক ব্যক্তি বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! প্রতি বছর কি হজ্ব করতে হবে? তিনি চুপ রইলেন এবং লোকটি এভাবে তিনবার জিজ্ঞেস করল। অতপর রাসূলুল্লাহ(সঃ) বললেন, আমি যদি হ্যাঁ বলতাম, তাহলে তা (প্রতি বছর হজ্ব করা) ফরয হয়ে যেতো, কিন্তু তোমাদের পক্ষে তা করা সম্ভব হতো না। (সহীহ মুসলিম)
*ইবনে আববাস রা. হতে বর্ণিত অনুরূপ হাদীসে আরো বলা হয়েছে, হজ্ব (ফরয) হল একবার, এরপরে যে অতিরিক্ত আদায় করবে তা নফল হিসেবে গণ্য।(মুসনাদে আহমদ ও সুনানে নাসায়ী)
হজ্ব যেহেতু একবারই ফরয তাই যার উপর হজ্ব ফরয হয়েছে সে যদি মৃত্যুর আগে যে কোনো বছর হজ্ব আদায় করে, তবে তার ফরয আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু হজ্ব বিধানের মৌলিক তাৎপর্য, তার যথার্থ দাবি ও আসল হুকুম হচ্ছে হজ্ব ফরয হওয়ার সাথে সাথে আদায় করা। বিনা ওজরে বিলম্ব না করা। কারণ বিনা ওজরে বিলম্ব করাও গুনাহ। আল্লাহ তাআলা ও তার রাসূল ফরয হজ্ব আদায়ের প্রতি এমনভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন যে, কেউ যদি এই হজ্বকে অস্বীকার করে বা এ বিষয়ে কোনো ধরনের অবহেলা প্রদর্শন করে তবে সে আল্লাহর জিম্মা থেকে মুক্ত ও হতভাগ্যরূপে বিবেচিত হবে।
*আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন,মানুষের মধ্যে যারা সেখানে (বায়তুল্লাহ) পৌঁছার সামর্থ্য রাখে তাদের উপর আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ গৃহের হজ্ব করা ফরয। আর কেউ যদি অস্বীকার করে তাহলে তোমাদের জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিজগতের প্রতি মুখাপেক্ষী নন।(সূরা আলে ইমরানঃ৯৭)
তাছাড়া যে কোনো ধরনের বিপদ-আপদ, অসুখ-বিসুখের সম্মুখীন হওয়া বা মৃত্যুর ডাক এসে যাওয়া তো অস্বাভাবিক নয়। তাই হজ্ব ফরয হওয়ার পর বিলম্ব করলে পরে সামর্থ্য হারিয়ে ফেললে বা মৃত্যুবরণ করলে আল্লাহ তাআলার নিকট অপরাধী হিসেবেই তাকে হাজির হতে হবে। এজন্যই হাদীস শরীফে হজ্ব ফরয হওয়ামাত্র আদায় করার তাগিদ ও হুকুম দেওয়া হয়েছে।
*ইবনে আববাস (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু(সঃ) ইরশাদ করেছেন,যে ব্যক্তি হজ্ব করার ইচ্ছে করে, সে যেন তাড়াতাড়ি তা আদায় করে নেয়। কারণ যে কোনো সময় সে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে বা বাহনের ব্যবস্থাও না থাকতে পারে অথবা অন্য কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে (সুনানে ইবনে মাজাহ ও সুনানে আবু দাউদ)
*অন্য বর্ণনায় ইরশাদ হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ইরশাদ করেছেন,ফরয হজ্ব আদায়ে তোমরা বিলম্ব করো না। কারণ তোমাদের কারো জানা নেই তোমাদের পরবর্তী জীবনে কী ঘটবে।
*হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তাআলা বলেন,আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ(সঃ) ইরশাদ করেছেনঃ
আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি আমার বান্দার শরীরকে সুস্থ রাখলাম, তার রিযিক ও আয়-উপার্জনে প্রশস্ততা দান করলাম। পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও যদি সে আমার গৃহের হজ্বের উদ্দেশ্যে আগমন না করে তবে সে হতভাগ্য, বঞ্চিত।(সহীহ ইবনে হিব্বান)
*আবু হোরায়রা(রাঃ) বর্ণিত এক হাদিসে নবী মুহাম্মাদ(সঃ) বলেছেন: যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ্ব করে এবং অশ্লীল ও গোনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকে, সে হজ্ব থেকে এমতাবস্থায় ফিরে আসে যেন আজই মায়ের গর্ভ থেকে বের হয়েছে। অর্থাৎ জন্মের পর শিশু যেমন নিষ্পাপ থাকে, সেও তদ্রূপই হয়ে যায়।(বুখারী)
*তিনি আরো বলেছেন, শয়তান আরাফার দিন হতে অধিক লজ্জিত ও অপদস্থ আর কোনো দিন হয় না, কেননা ওই দিন আল্লাহ তায়ালা স্বীয় বান্দার প্রতি অগণিত রহমত বর্ষণ করেন ও অসংখ্য কবিরা গুনাহ ক্ষমা করে দেন।(আল-হাদীস)
*তিনি আরো বলেছেন, একটি বিশুদ্ধ ও মকবুল হজ্ব সমগ্র পৃথিবী ও পৃথিবীর যাবতীয় বস্তুর চেয়ে উত্তম। বেহেস্ত ব্যতীত অন্য কোনো বস্তু তার প্রতিদান হতে পারে না।(আল-হাদীস)
★হজ্বের ফযিলত:
১. হজ্ব পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মুছে দেয়:আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ(সঃ) ইরশাদ করেছেন,যে ব্যক্তি হজ্ব করে আর তাতে কোনোরূপ অশ্লীল ও অন্যায় আচরণ করে না তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।(সুনানে তিরমিযী)
অন্য বর্ণনায় রয়েছে,আবু হুরায়রা রা. বলেন, আমি নবী করীম (সঃ) কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্ব করল এবং অশ্লীল কথাবার্তা ও গুনাহ থেকে বিরত থাকল সে ঐ দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে হজ্ব থেকে ফিরে আসবে যেদিন মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হয়েছিল।(সহীহ বুখারী)
২. হজ্বে মাবরূরের প্রতিদান হল জান্নাত: আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু (সঃ) ইরশাদ করেছেন,এক উমরা আরেক উমরা পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহর ক্ষতিপূরণ হয়ে যায়। আর হজ্বে মাবরূরের প্রতিদান তো জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়। (সহীহ বুখারী)
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু(সঃ) ইরশাদ করেছেন,তোমরা হজ্ব ও উমরা পরপর একত্রে পালন কর। কেননা এ দুটি (হজ্ব ও উমরাহ) দারিদ্র ও গুনাহসমূহ এমনভাবে দূর করে দেয় যেমন কামারের হাপর লোহা ও সোনা-রূপার ময়লা দূর করে দেয়। আর হজ্বে মাবরূরের বিনিময় জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়। (সুনানে তিরমিযী, হাদীস)
৩. সর্বোত্তম আমল হজ্বে মাবরূর: হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,নবী করীম সাল্লাল্লাহু(সঃ) কে জিজ্ঞাসা করা হল, সর্বোত্তম আমল কোনটি? তিনি বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনা। জিজ্ঞাসা করা হল, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদ করা। জিজ্ঞাসা করা হল, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, হজ্বে মাবরূর বা কবুল হজ্ব। (সহীহ বুখারী)
মায়িয রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু(সঃ) কে জিজ্ঞাসা করা হল, কোন আমল সর্বোত্তাম? তিনি বললেন, এক আল্লাহ তাআলার প্রতি ঈমান আনা। তারপর জিহাদ করা। অতপর কবুল হজ্ব অন্যান্য আমল হতে এত উৎকৃষ্ট ও মর্যাদাপূর্ণ যেরূপ সূর্যের উদয়াচল হতে অস্তাচলের ব্যবধান।(মুসনাদে আহমদ)
৪. নারী, বৃদ্ধ, দুর্বল ব্যক্তি ও শিশুদের জিহাদ হল হজ্ব ও উমরাহ: উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা তো জিহাদকে সর্বোত্তম আমল মনে করি। আমরা কি জিহাদ করব না? তিনি বললেন, না। বরং তোমাদের নারীদের জন্য সর্বোত্তম জিহাদ হল হজ্বে মাবরূর।(সহীহ বুখারী)
আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাললাল্লাহু(সঃল বলেছেন,বৃদ্ধ, দুর্বল ও নারীর জিহাদ হল হজ্ব ও উমরা। (মুসনাদে আহমদ)
৫. হজ্ব ও উমরাকারীর দুআ কবুল করা হয়: জাবির রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু(সঃল ইরশাদ করেছেন,হজ্ব ও উমরাকারীগণ আল্লাহর প্রতিনিধি দল। তারা দুআ করলে তাদের দুআ কবুল করা হয় এবং তারা কিছু চাইলে তাদেরকে তা দেওয়া হয়।(মুসনদে বাযযার)।
ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণিত, নবী করীম সাললাল্লাহু(সঃ) বলেছেন,আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী (গাযী), হজ্ব ও উমরা আদায়কারীগণ আল্লাহর প্রতিনিধি দল। তারা দুআ করলে দুআ কবুল করা হয় এবং তারা কিছু চাইলে তাদেরকে তা দেওয়া হয়। (সুনানে ইবনে মাজাহ)।
৬. হাজীদের গুনাহ মাফ হয় এবং তারা যাদের গুনাহ ক্ষমা চায় তাদেরকে মাফ করা হয়: আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু(সঃ) ইরশাদ করেছেন,আল্লাহ তাআলা হাজীদের গুনাহ ক্ষমা করেন এবং হাজী যাদের জন্য ক্ষমা প্রর্থনা করেন, তাদেরকেও ক্ষমা করেন। (সহীহ ইবনে খুযাইমা)।
অন্য বর্ণনায় রয়েছে, হজ্ব ও উমরাকারীগণ যখন দুআ করে, তাদের দুআ কবুল করা হয়। তারা যখন কারো জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে তাদেরকে ক্ষমা করা হয়। (সুনানে ইবনে মাজাহ)
৭. হজ্ব ও উমরার জন্য খরচ করার ফযীলত: আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু(সঃ) উমরা করার সময় তাকে তার উমরা সম্পর্কে বলেছেন, তুমি তোমার পরিশ্রম ও খরচ অনুপাতে নেকি পাবে।(মুসতাদরাকে হাকিম)
বুরাইদা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু(সঃ) ইরশাদ করেছেন,হজ্বের জন্য খরচ করা, আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার মতই, যার সওয়াব সাতশ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। (মুসনাদে আহমাদ)।
৮. হজ্ব ও উমরা পালনকালে মৃত্যুবরণকারীর ফযীলত: ইবনে আববাস রা. হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি আরাফাতের ময়দানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু(সঃ) এর সাথে উফূফরত ছিলেন। হঠাৎ তিনি বাহন থেকে নীচে পড়ে গেলেন। এতে তার ঘাড় মটকে গেল এবং তিনি মারা গেলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু(সঃ) বললেন, তাকে বড়ইপাতা সিদ্ধকরা পানি দিয়ে গোসল দাও, তার দুই কাপড় দিয়ে তাকে কাফন পরাও। তাকে সুগন্ধি লাগিও না এবং তার মাথাও আবৃত করো না। কেননা তাকে কিয়ামতের দিন তালবিয়া পাঠরত অবস্থায় উঠানো হবে।(সহীহ বুখারী)
৯. তালবিয়া পাঠ ও উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠের ফযীলত: আবু বকর সিদ্দীক রা. হতে বর্ণিত,নবী কারীম সাল্লাল্লাহু(সঃ) কে জিজ্ঞেস করা হল, কোন হজ্ব সর্বোত্তম? তিনি বললেন, যে হজ্বে উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠ করা হয় এবং কুরবানী করা হয়।(সুনানে তিরমিযী)
সাহল ইবনে সা’দ রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু(সঃ) বলেন,যে কোনো মুসলমান তালবিয়া পাঠ করল, তার তালবিয়া পাঠের অনুসরণে তার ডান ও বামের বৃক্ষরাজি সবকিছুই তার সাথে তালবিয়া পাঠ করে, যতক্ষণ না যমীন তার এদিক তথা ডান ও বাম পার্শ্ব হতে ধ্বংস হয়ে যায়। (সুনানে তিরমিযী)
১০. বাইতুল্লাহ তাওয়াফের ফযীলত: ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু(সঃ) কে বলতে শুনেছি,যে ব্যক্তি যথাযথভাবে সাতবার বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করে এবং দুই রাকাত সালাত আদায় করে তার একটি গোলাম আযাদ করার সমান সওয়াব হয়। তাওয়াফের প্রতি কদমে আল্লাহ তার একটি করে গুনাহ মাফ করেন, একটি করে নেকী লেখেন এবং দশটি মর্যাদা প্রদান করবেন। (মুসনাদে আহমদ)
১১. হাজরে আসওয়াদ ও রূকনে ইয়ামানী স্পর্শ করার ফযীলত: ইবনে ওমর রা. বর্ণনা করেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু(সঃ) কে বলতে শুনেছি, হাজরে আসওয়াদ ও রূকনে ইয়ামানীর স্পর্শ পাপসমূহকে মুছে দেয়। (সুনানে তিরমিযী)
ইবনে আববাস রা. হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাললাল্লাহু(সঃ) বলেছেন, অবশ্যই আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন হাজরে আসওয়াদকে উঠাবেন। তার দুটি চোখ থাকবে, যা দিয়ে সে দেখতে পাবে। একটি জিহবা বা মুখ থাকবে, যা দিয়ে সে কথা বলবে এবং যারা তাকে যথার্থভাবে স্পর্শ করেছে তাদের পক্ষে সাক্ষ্য দেবে।(সুনানে তিরমিযী)
১২. ইয়াওমে আরাফার ফযীলত: অব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. হতে বর্ণিত, নবী করীম সাললাল্লাহু(সঃ) বলেছেন,আরাফার অধিবাসীদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের নিকট গর্ব করেন এবং তাদেরকে বলেন, তোমরা আমার বান্দাদের দিকে তাকিয়ে দেখ, তারা এলোমেলো চুলে, ধূলোমলিন অবস্থায় আমার কাছে এসেছে। (মুসনাদে আহমদ)
আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাললাল্লাহু(সঃ) বলেছেন,আরাফার দিন অপেক্ষা এমন কোনো দিন নেই যেদিন আল্লাহ তাআলা অত্যাধিক পরিণামাণে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করেন এবং তিনি নিকটবর্তী হন। আর ফেরেশতাদের নিকট তাদেরকে নিয়ে গর্ব করে বলেন, এরা কি চায়? (সহীহ মুসলিম)
★হজ্জের প্রকার:
১. ইফরাদ: ওমরাহ্ ব্যতিত শুধু হজ্জের জন্য ইহরাম বাঁধা এবং হজ্জের সাথে ওমরাহকে না মিলানো।
২. কি্বরান: একত্রে একই স্থান থেকে হজ্জ ও ওমরার নিয়্যাত করে হজ্জের সাথে ওমরাহকে মিলানো এবং একই ইহরামে উভয়টি আদায় করা।
৩. তামাত্তু: একই সফরে পৃথক পৃথক ভাবে ‘ইহরাম’ পরিধান করে ‘হজ্জ ও ওমরাহ’ আদায় করা। প্রথম ইহরামে ওমরাহর নিয়্যাত করে তা পালন শেষে চুল কেটে ইহরাম।খুলে হালাল হয়ে দ্বিতীয় বার নতুন করে হজ্জের নিয়্যাতে ৮ই জিলহজ্জ ‘মক্ক শরীফ’ থেকে হজ্জের জন্য ইহরাম বাধা। তামাত্তু করার ইচ্ছা থাকলে প্রথমে ওমরার নিয়্যাত করে এহরাম বাঁধুন।
★হজ্জের ফরজ-৩টি
১. ইহরাম বাধা।
২. উ’কুফে আ’রাফা।
(আরাফাতের ময়দানে অবস্থান)
৩. তাওয়াফে যিয়ারাত।
★হজ্জের ওয়াজিব-৬টি
১. ‘সাফা ও মারওয়া’পাহাড় দ্বয়ের মাঝে ৭ বার সায়ী করা।
২. অকুফে মুযদালিফায় (৯ই জিলহজ্জ) অর্থাৎ সুবহে সাদিক থেকে সুর্যদয় পর্যন্ত একমুহুর্তের জন্য হলেও অবস্থান করা।
৩. মিনায় তিন শয়তান (জামারাত) সমূহকে পাথর নিপে করা।
৪. হজ্জে তামাত্তু ও ‘কি্বরান’ কারীগণ ‘হজ্জ’ সমাপনের জন্য দমে শোকর করা।
৫. এহরাম খোলার পূর্বে মাথার চুল মুন্ডানো বা ছাটা।
৬. মক্কার বাইরের লোকদের জন্য তাওয়াফে বিদা অর্থাৎ মক্কা থেকে বিদায়কালীন তাওয়াফ করা।
★ওমরাহর ফরজ ও ওয়াজিব:
*ফরজ- ২টি
১. ইহরাম পরিধান করা।
২. তাওয়াফ।
*ওয়াজিব-২টি
১. সাফা ও মারওয়া মধ্যবর্তী (সবুজ বাতি) স্থানে সাতবার সায়ী করা।
২. মাথার চুল মুন্ডানো বা ছাটা।
★তালবিয়া: ‘লাব্বাঈক আল্লাহুম্মা লাব্বাঈক, লাব্বাঈক, লা-শারীকা-লাকা লাব্বাঈক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্ নি’মাতা লাকা ওয়াল-মুল্ক, লা শারীকালাক।’
অর্থ: আমি হাজির হে আল্লাহ! আমি উপস্থিত! আপনার ডাকে সাড়া দিতে আমি হাজির। আপনার কোন অংশীদার নেই। নিঃসন্দেহে সমস্ত প্রশংসা ও সম্পদরাজি আপনার এবং একচ্ছত্র আধিপত্য আপনার। আপনার কোন অংশীদার নেই।
★ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজ:
১. সেলাইযুক্ত যে কোন কাপড় বা জুতা ব্যবহার, এক্ষেত্রে স্পঞ্জ সেন্ডেলের ব্যবহার করা।
২. মস্তক ও মুখমন্ডল যে কোন কাপড় দ্বারা ঢাকা।
৩. পায়ের পিঠ ঢেকে যায় এমন জুতা পরা।
৪. চুলকাটা বা ছিড়ে ফেলা।
৫. নখকাটা।
৬. ঘ্রানযুক্ত তৈল বা আতর লাগানো।
৭. স্ত্রীর সঙ্গে সংগম করা।
৮. যৌন উত্তেজনামূলক কোন আচরণ বা কোন কথা বলা।
৯. শিকার করা।
১০. ঝগড়া বিবাদ বা যুদ্ধ করা।
১১. চুল দাড়িতে চিরুনী বা আঙ্গুলী চালনা করা, যাতে ছিড়ার আশংকা থাকে।
১২. শরীরে সাবান লাগানো।
১৩. উকুন, ছারপোকা, মশা ও মাছিসহ কোন জীবজন্তু হত্যা করা বা মারা।
১৪. কোন গুনাহের কাজ করা, ইত্যাদি।
★তাওয়াফের বিবরণ: হাজীদের সর্বপ্রথম কাজই হলো (তামাত্তু ও ক্বেরান কারীগণ) নিজের মালছামানগুছিয়ে রেখে পাক-পবিত্র হয়ে মোটেই দেরী না করে ‘হারাম শরীফে’ হাজিরা দেওয়া এবং ‘তাওয়াফ’ করা। ওমরাহ এবং হজ্জের তাওয়াফ ব্যাতিত নফল তাওয়াফ ও করা যায়। যেমন: রাসূল (দঃ), সাহাবা-আওলিয়া, আহলে বাইত, মা-বাবা, পীর-উস্তাদ ও অন্যান্য মুরুব্বী বা সন্তানদের স্মরনে বা তাঁদের নামে তাওয়াফ করা।
★তাওয়াফের ওয়াজিব সমূহ:
১. শরীর পাক রাখা, ওজু করা। মহিলাদের হায়েজ নেফাছ অবস্থায় তাওয়াফ করা জায়েজ নাই।
২. ছতর ঢাকা।
৩. ‘হাতীমে কা’বার’ বাইরে থেকে ‘তাওয়াফ’ করা।
৪. পায়ে হেঁটে ‘তাওয়াফ’ করা। অক্ষম ব্যক্তি খাটিয়ার মাধ্যমে ‘তাওয়াফ’ করতে পারবেন।
৫. ‘হাজরে আস্ওয়াদ’ থেকে শুরু করে ডানদিক দিয়ে ‘তাওয়াফ’ শুরু করা।
৬. এক নাগাড়ে বিরতিহীন ভাবে ‘সাতবার চক্কর’ দিয়ে ‘তাওয়াফ’ পূর্ণ করা।
৭. ‘সাত চক্করে’ এক ‘তাওয়াফ’, এটা পূর্ণ হলেই ‘তাওয়াফের’ নামাজ পড়া।
★তাওয়াফের সুন্নত কার্যাবলী:
১. ‘তাওয়াফে’র শুরুতে ‘হাজারে আসওয়াদ’ এর দিকে মুখ করা।
২. সম্ভব হলে হাজরে আস্ওয়াদ চুম্বন করা। নতুবা হাত দ্বারা দূর থেকে ইশারা করা।
৩. হাজরে আস্ওয়াদ বরাবর দাঁড়িয়ে তাকবীরে তাহরিমা’র ন্যায় উভয় হাত সিনা পর্যন্ত উঠান।
৪. যে ‘তাওয়াফে’র পরে ‘সাঈ’ আছে তাতে ‘এযতেবা’ করা। অর্থাৎ ইহরামের চাদরের (উপরের অংশের) দুই মাথা ডান বগলের নিচ দিয়ে বাম কাঁধের উপর ফেলে দেওয়া।
৫. ‘সাঈ’ যুক্ত ‘তাওয়াফে’র প্রথম তিন চক্করে ‘রমল’ করা। অর্থাৎ বীরের মত হেলে দুলে জোর ক্বদমে (একের পর এক পা ফেলে) চলা।
৬. বাকী চার চক্কর সাধারণ গতিতে (ধীরে ধীরে) সম্পন্ন করা।
৭. প্রত্যেক চক্কর তাওয়াফ শেষ করে এবং শেষ চক্করেরও পরে হাজরে আস্ওয়াদ কে চুম্বন করা।
সম্ভব না হলে দূর থেকে ইশারা করে বিসমিল্লাহে আল্লাহ আকবর ওয়ালিল্লাহিল হামদ্”দোয়াটি পাঠ করা এবং ৩ নং নিয়মের ন্যায় দাড়িয়ে ইশারা করে ‘তাওয়াফ’ শেষ করা।
*তাওয়াফের নিয়্যাত: আল্লাহুম্মা ইন্নী উরীদু তাওয়াফা বাইতিকাল হারাম ফায়াচ্ছিরহু-লী, ওয়া তাক্বাব্বাল-হু-মিন্নী, সাবাআ’তা আশ্ওয়াতি্বন লিল্লাহি তায়া’লা।
বাংলায় নিয়ত- হে আল্লাহ আমি তাওয়াফ পালনের জন্য নিয়ত করলাম।
*সায়ীর নিয়ম: ‘হজ্জ ও ওমরাহ’ ছাড়া নফল ‘তাওয়াফে’র কোন সায়ী নাই। কারো নামে ওমরাহ করতে হলেও সায়ী করতে হবে। সায়ী অর্থ দৌড়ানো। এটা ‘ছাফা’ পাহাড় থেকে প্রথমে শুরু করতে হবে। ছাফা থেকে মারওয়া।মারওয়া থেকে ছাফায়। এভাবে সাতবার সায়ীর সময় প্রথম তিন চক্কর সবুজ বাতির মাঝের অংশটুকু দৌড়ে দৌড়ে হেলে দুলে যাওয়া সুন্নাত (পুরুষদের জন্য)। পরের চার চক্কর সাধারণ গতিতে সম্পন্ন করতে হবে।
*সায়ীর সহজ দোয়া: সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদু লিল্লাহি ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার ওয়া লা-হাওলা, ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লাবিল্লাহিল আ’লিয়্যিল আ’যীম, রাবি্বগফির ওয়ারহাম ওয়াআনতাল আ-আজ্জুল আকরাম।
*সায়ীর কুরআনী দোয়া: ‘ইন্নাছ্ ছাফা ওয়াল মারওয়াতা মিন্ শাআ’ইরিল্লাহ্ ফামান হাজ্জাল বাইতা আও-ই’ তামারা ফালা জুনাহা আ’লাইহি আইয়াত্ত্বাওয়াফা বিহিমা ওমান তাত্বাওয়াআ খাইরান ফা-ইন্নাল্লাহা শাকিরুণ আ’লীম।”
উপরোক্ত দুই দোয়া সাতবার চক্করের সময় হাটতে চলতে পড়তে হবে। পরেরটি না পারলে উপরেরটিই যথেষ্ট হবে।
হে আল্লাহ তুমি আমাদের সকলকে তোমার ঘর তাওয়াফ করার তাওফিক দিও।জীবনে একবার হলেও হজ্ব করার তাওফিক দেও। আমিন
লেখক: আমির হামজা (সায়েম)