নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গত ২১ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ কর্মীরা বিএনপি ও এনসিপি নেতাদের যে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করেছে, তা সাধারণ মানুষের ভেতর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। বিশেষ করে এনসিপির জেষ্ঠ্য যুগ্ম-সদস্য সচিব ডা.তাসনিম জারাকে যে নোংরা ও অশ্লীল ভাষায় কটূক্তি করেছে, তা বর্ণনাতীত। শেখ হাসিনার কর্মীদের এসব কটূক্তি নিয়ে নেটদুনিয়ায় বিস্তর তোলপাড় হয়েছে। যে যার দৃষ্টিকোণ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য করে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
এসব প্রতিক্রিয়ার মধ্যে দু-একটি তির্যক মন্তব্য অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এক নেটিজেন লিখেছেন,‘ পনেরো বছর ধরে যে দলীয় নেত্রীর মুখে প্রতিপক্ষকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে শুনেছি, সেই নেত্রীর কর্মীদের মুখে এমন অকথ্য ভাষা শোনা যাবে, এটাই তো স্বাভাবিক! নোংরা ভাষায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করাই এখন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই একটি অংশ’। অন্য আরেকজন লিখেছেন, ‘ছি..ছি.. ছি হাসিনার কর্মীরা যে ঘৃণ্য ‘বিশেষণ’ দিয়ে ডা. তাসনিম জারাকে গালি দিয়েছে, তাতে হাসিনা নিশ্চয়ই খুশি হয়েছেন। হাসিনার মতো নোংরা মনের মানুষের পক্ষেই তা সম্ভব!’
ওপরের মন্তব্যগুলো নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করা যেতে পারে; তবে এসব মন্তব্য যে একেবারে ভিত্তিহীন, তা বলা যাবে না। হাসিনার শাসনামলে কর্মী সভা, জনসভা, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বক্তৃতা-বিবৃতি এবং টকশোতে আওয়ামী লীগের অধিকাংশ জ্যেষ্ঠ নেতাকে প্রতিপক্ষের নেতা-নেত্রীকে নিয়ে এমন অনেক নোংরা ভাষায় কথা বলতে শুনেছি। আওয়ামী লীগের পরিচিত এক নেতার মুখেই তখন শুনেছিলাম, প্রতিপক্ষ, বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দলের নেত্রীকে নিয়ে নোংরা ভাষায় কথা বললে নাকি তার দলীয় নেত্রী খুশি হতেন।
নেটদুনিয়ায় খোঁজাখুঁজি করলেই আওয়ামী লীগ নেতার এ কথার সত্যতা পাওয়া যাবে। বিভিন্ন উপলক্ষ্যে শেখ হাসিনাকেও প্রকাশ্য দিবালোকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে নির্দ্বিধায় ‘কুলাঙ্গার’ বলে গালি দিতে শুনেছি। হাসিনার এ নোংরা আচরণের আছর যে তার কর্মীদের গায়ে লাগবে, সেটাই স্বাভাবিক। তারই পুনরাবৃত্তি এবার দেখলাম জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।
পৃথিবীর সব দেশের রাজনীতিতেই সহিংসতা আছে। তবে তা তাদের দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এক্ষেত্রে একমাত্র বাংলাদেশই ব্যতিক্রম। বাংলাদেশের রাজনীতির সহিংসতার ঝাঁজ এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বহির্বিশ্বেও পাওয়া যায়। দেশের বৃহৎ দুটি রাজনৈতিক দলের প্রবাসী নেতাকর্মীরা বিদেশের মাটিতে বসে একে অপরকে হেনস্তা করতে সিদ্ধহস্ত হয়ে গেছে। বিশেষ করে এ দুটি দলের দলীয়প্রধানরা যখন বিদেশ সফর করেন, তখন এ দৃশ্য দেখা যায়। এতদিন নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন পোস্টার ও প্ল্যাকার্ড হাতে রাজনৈতিক স্লোগানই ছিল প্রতিবাদের ভাষা।
চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনা ও তার দোসররা বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই এ প্রতিবাদের ধরন পালটিয়েছে। প্রায় এক বছর ধরে আওয়ামী লীগের প্রবাসী কর্মী ও সমর্থকরা যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদ বাদ দিয়ে সহিংসতার পথ বেছে নিয়েছে।
গত বছরের নভেম্বরে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে হেনস্তা করা হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবসের প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম গত আগস্টে নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলে একটি মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হিসাবে যোগ দেন। সে সময় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাদের ক্ষোভ ঢালতে গিয়ে কনস্যুলেট ভবনে হামলা চালায় এবং ভবনের কাচের দরজা ভেঙে ফেলে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো ঘটেনি। ১২ সেপ্টেম্বর লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্কুল অব আফ্রিকান অ্যান্ড ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ (সোয়াস) ক্যাম্পাসে আয়োজিত একটি সেমিনারেও উপদেষ্টা মাহফুজ আলম একজন বক্তা হিসাবে অংশগ্রহণ করেন।
সেমিনার শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তার ওপর আবারও হামলার চেষ্টা করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। সোয়াস ক্যাম্পাস থেকে হাইকমিশনের গাড়ি বের হলে ওই গাড়িতে মাহফুজ আলম আছেন ভেবে আওয়ামী লীগের কয়েকজন কর্মী গাড়ির সামনে শুয়ে পড়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু পুলিশের হস্তক্ষেপে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ফলে গাড়ি দ্রুত চলে যাওয়ার সময় তারা গাড়ির ওপর ডিম ছুড়ে মারেন। পরে জানা যায়, ওই গাড়ির ভেতরে মাহফুজ আলম ছিলেন না। এসব ঘটনায় বোঝা যায়, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে যেসব তরুণ নেতার কারণে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন, আওয়ামী লীগ তাদের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেছে। তাদের টার্গেট করে বিদেশের মাটিতে দলের উপরের নির্দেশেই এসব হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।
নিউইয়র্কের ঘটনায় এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন ও ডা. তাসনিম জারাকে হেনস্তা করার ঘটনায় তা আরও স্পষ্ট হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ডা. তাসনিম জারার মতো একজন নারীকে এমন অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়ে কিংবা মাহফুজ আলম ও আখতার হোসেনকে ডিম ছুড়ে আওয়ামী লীগ কী অর্জন করল?
এনসিপির আখতার হোসেনের পিঠে ডিম ছোড়াকে আওয়ামী লীগ বিরাট সাফল্য হিসাবে দেখছে। দলের নেতাকর্মীদের প্রতিক্রিয়ায় তার প্রতিফলন আমরা দেখেছি। নিউইয়র্কে গ্রেফতার যুবলীগের সেই কর্মী জামিনে বেরিয়ে আসার পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাকে বীরের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, বেরিয়ে আসার পরপরই মোবাইল ফোনে শেখ হাসিনাকে তার সঙ্গে কথা বলতেও দেখা যায়। হাসিনার সঙ্গে কথা বলার সেই ভিডিও নেটদুনিয়ায় এখন ভেসে বেড়াচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়েও অনেক সমালোচনা চলছে।
মোবাইল ফোনে শেখ হাসিনার কথোপকথনের সেই ভিডিওটি শেয়ার করে আনারুল জাহিদ নামে একজন লিখেছেন, ‘ভিডিওটি দেখে সত্যিই বিস্মিত হলাম! হাসিনা যে গডগিফটেড প্রতিশোধপরায়ণ! অন্যায়কারীকে পুরস্কৃত করা, অন্যায়কারীর পক্ষে থাকা, অন্যায়কারীকে উৎসাহিত করা, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই ভিডিওটি।’ জাহিদের এ বক্তব্য সঠিক কি না, তা নেটিজনেরাই বিবেচনায় নেবেন। তবে জাহিদ যাকে অন্যায় মনে করছেন, শেখ হাসিনা যে তাই মনে করবেন; তা তিনি কীভাবে নিশ্চিত হলেন? এমনও তো হতে পারে, তার নির্দেশেই যুবলীগ কর্মীটি তাদের ভাষায়-‘বীরত্বপূর্ণ’ কাজটি করেছেন। সমাজের মানুষ যাকে অন্যায় বা ভুল মনে করেন, আওয়ামী লীগ নেতা সেটি নাও করতে পারেন।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদের দেশ ছেড়ে পলায়নের পর পত্রিকায় প্রকাশিত জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সোহরাব হাসানের লেখা নিবন্ধের একটি বক্তব্যের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি লিখেছেন, ‘ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে জিজ্ঞেস করেছি, আপনাদের ভুল কী? তারা একবাক্যে বলেছেন, কোনো ভুল নেই। একটি সরকারের পনেরো বছরে অসংখ্য ভুলকে সঠিক মনে করাই ছিল তাদের সবচেয়ে বড় ভুল।’ ঠিক এভাবেই জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে তাদের যে পতন হয়েছে, তা আওয়ামী লীগ এখনো মেনে নিতে পারছেন না।
ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থানকে বিদেশি ষড়যন্ত্র হিসাবেই তারা দেখছেন। এতদিন পরও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ভেতর অতীতের ভুলত্রুটি স্বীকার করার মতো কোনো মানসিকতা দেখা যাচ্ছে না। সহস্রাধিক মানুষ হত্যা করেও আওয়ামী লীগের ভেতর কোনো পরিবর্তন দেখি না। তাদের কথায় কিংবা বক্তব্যে অনুশোচনা প্রকাশের কোনো ইঙ্গিতও নেই। এ দলটির প্রতি মানুষের বিশ্বাস ও আস্থার যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা দূর করতে কোনো বিকল্প পরিকল্পনা রয়েছে; তাদের এসব হীন কার্যকলাপ দেখে তাও মনে হয় না।
আওয়ামী লীগ দেশের রাজনীতিতে ফিরে আসতে মরিয়া হয়ে যে পথ বেছে নিয়েছে, তা সাধারণ মানুষ ভালোভাবে গ্রহণ করছে কি না, সে বিষয়ে তাদের চিন্তাভাবনা আছে কি না জানি না। আওয়ামী লীগের পনোরো বছরের স্বৈরশাসনের সময় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সরকরের বিরুদ্ধে ফলপ্রসূ আন্দোলন গড়তে বারবার যেখানে ফেল করেছে; সেখানে এসব তরুণই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ এখন তাদেরকেই টার্গেট করে হিংসাত্মক আক্রমণ করে কী অর্জন করছে, তারাই ভালো বলতে পারবেন।
বিদেশের মাটিতে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে দেশের মানুষ এবং আন্তর্জাতিক মহলে যে বার্তা তারা পৌঁছে দিচ্ছে, তা আওয়ামী লীগের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না। মস্তানি কিংবা গায়ের জোরে আর যাই হোক বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের পুনর্বাসন সম্ভব নয়। রাজনীতিতে ফিরে আসতে হলে সহিংসতার পথ ছেড়ে এ দেশের মানুষের মন জয় করতেই হবে।
স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের প্রথম যে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটেছিল, তা হলো পঁচাত্তরের সামরিক অভ্যুত্থান। সে অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতায় ফিরে আসতে তাদের একুশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। মনে রাখতে হবে, পঁচাত্তরে ছিল শুধু সামরিক অভ্যুত্থান, যে অভ্যুত্থানে দেশের সাধারণ মানুষের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। সামরিক বাহিনীর কিছু সদস্য কেবল জড়িত ছিলেন। কিন্তু চব্বিশের অভ্যুত্থান কোনো বাহিনীর অভ্যুত্থান নয়। এটি তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে দেশের সব মানুষের অংশগ্রহণে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান।
এ গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে জুলাই-আগস্টে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, যার মধ্যে দেড় শতাধিকই ছিল শিশু-কিশোর; সে দগদগে স্মৃতি এদেশের মানুষের মন থেকে সহজেই মুছে ফেলা যাবে না। প্রথমে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন এবং পরে চব্বিশের ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান’-এর সময় আওয়ামী লীগ তরুণ সমাজের সঙ্গে যে বৈমাত্রেয়সুলভ আচরণ করেছে, সে আচরণও তরুণ সমাজ ভুলে যাবে না। পনোরো থেকে পঁচিশ বছরের যেসব তরুণ এ অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছেন; কম করে হলেও আগামী তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর তারাই এদেশের গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে অগ্রভাগে থাকবেন। কাজেই আগামী দিনে এ দেশে রাজনীতি করতে হলে আওয়ামী লীগকে এ সবকিছুই বিবেচনায় নিতে হবে।
লেখক: একেএম শামসুদ্দিন, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল