সরকারি হাসপাতালগুলোয় মুমূর্ষু রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) না থাকার বিষয়টি নতুন নয়। পরিতাপের বিষয়, দীর্ঘদিন যাবৎ এ বিষয়টি প্রকাশ্যে এলেও কর্তৃপক্ষের তরফে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। রোববার যুগান্তরের খবরে প্রকাশ, দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ সংকট এতটাই ভয়াবহ যে, আইসিইউ’র বেডে থাকা কারও মৃত্যু না হলে অন্য কারও সেখানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ মেলে না। শুধু তাই নয়, সারা দেশে সরকারি-বেসরকারিভাবে স্থাপিত মোট কতটি আইসিইউ রয়েছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে সেই তথ্যও নেই।

প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট, গুরুতর অসুস্থ রোগীর জীবন বাঁচানোর অতি প্রয়োজনীয় আইসিইউ সুবিধাটি স্বজনদের কাছে যেন ‘সোনার হরিণ’ হয়ে উঠেছে। গুরুতর অসুস্থ একজন মানুষের জন্য যখন দ্রুততম সময়ের মধ্যে জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা প্রয়োজন, তখন তাকে আইসিইউ’তে বেড খালি না থাকার কারণে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরতে হচ্ছে। আমরা মনে করি, দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোয় এই পরিস্থিতি শুধু একটি প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, বরং এটি আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মানবিক দিকটির এক করুণ প্রতিফলনও। সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা পেতে হলে এক রোগীকে আরেক রোগীর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এটি যে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার এক নির্মম চিত্র, তা বলাই বাহুল্য। আমাদের অনুধাবনের প্রয়োজন রয়েছে যে, যখন জীবন-মৃত্যুর মাঝে ঝুলে থাকা একজন মানুষ আইসিইউতে ভর্তির সুযোগের জন্য অপেক্ষায় থাকে, তখন সেই প্রতিটি মুহূর্ত শুধু রোগীর জন্যই নয়, স্বজনদের জন্যও এক অসহনীয় যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশের প্রধান সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউর জন্য প্রতিদিন যে পরিমাণ আবেদন জমা পড়ে, তার তুলনায় শয্যার সংখ্যা খুবই নগণ্য। যেমন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন ২৫টি আবেদনের বিপরীতে মাত্র দুজনকে ভর্তি করা সম্ভব হয়। একইভাবে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও প্রতিদিন ৪০-৫০টি আবেদনের মধ্যে মাত্র ৩ থেকে ৭ জন রোগীর ভর্তির সুযোগ মেলে। পরিসংখ্যানের এ দুটি তথ্যেই পরিষ্কার যে, স্বাস্থ্য খাতে অবকাঠামোগত ও জনবলের দিক দিয়ে আমরা কতটা পিছিয়ে আছি। এদিকে, সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ’র খরচ কম হওয়ায় এর চাহিদা আকাশচুম্বী; কিন্তু সরবরাহ নেই। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলো চিকিৎসার নামে এক বাণিজ্যিক চক্র তৈরি করেছে। কোনো বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ’তে ভর্তি থাকা একজন রোগীর দৈনিক খরচ ৩০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে, যা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। ফলে সরকারি হাসপাতালের ভর্তুকি জনগণের জন্য আশীর্বাদ হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তব পরিস্থিতি এই সুবিধাটিকে অর্থহীন করে তুলেছে।

এই সংকট নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। কেবল আইসিইউ শয্যা বাড়ালেই হবে না, এর সঙ্গে সঙ্গে দক্ষ জনবল তৈরি এবং তাদের পদায়নের দিকেও নজর দিতে হবে। পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ’র সঠিক সংখ্যা, মান ও অযৌক্তিক খরচের লাগাম টানতেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, দেশের স্বাস্থ্য খাতকে সত্যিকারের জনবান্ধব করে তুলতে হলে এ ধরনের সংকটকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে।