সরকারি চাকরিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরু হয় ১ জুলাই থেকে। পরে এ আন্দোলন থেকেই সরকার পতন হয়। গেলে ৮ জুলাই থেকে আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। শেষ হয় ৫ আগস্ট।
কিন্তু বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নিহতদের স্মরণে আগস্ট উল্লেখ না করে তারা জুলাই দিয়েই গণনা শুরু করে। সেই অর্থে দেশ পুনরায় স্বাধীনতা পায় ৩৬ জুলাই।
১ জুলাই থেকে শুরু করে ৩৬ জুলাই পর্যন্ত সকল ইতিহাস একটা ফ্রেমে বন্দি করেছেন বগুড়া জিলা স্কুল ও ভিএম স্কুলের বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা।
রঙ তুলিতে ফুটিয়ে তোলা শিক্ষার্থীদের এক একটি ছবি যেন আন্দোলনের প্রতিটি ক্ষণের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। আর সেই ছবিগুলো আঁকতে গিয়ে বার-বার বুকের ভিতরটা ও হাতের রঙ তুলিটা কেঁপে উঠেছে শিক্ষার্থীদের। পরিপূর্ণ এই দেয়ালের দিকে তাকালে যে কারও মনে হবে এক মুহূর্তে যেন আবছায়া হয়ে আন্দোলনে ঢুকে গেছেন, আবেগাপ্লুত হয়ে পড়বেন মুহূর্তে। আবার মনে আনন্দে হেসে উঠবেন এক মুহূর্তে।
গত ১৪ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট টানা ৭ দিন সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা কখনও রাত ১১টা অবধি কাজ করেছে ৪ আয়োজক ও ১২ শিক্ষার্থী। ভঙ্গুর দেয়ালের পোস্টার তোলা থেকে শুরু করে, ভাঙা অংশে সিমেন্ট বালুর আস্তরণ তৈরি, তা শুকিয়ে সেখানে রং লাগানো। তারপর আন্দোলনের এক-এক করে ‘আবু সাইদের বুক চিতিয়ে ধরা থেকে শেখ হাসিনার হেলিকপ্টারে করে পালিয়ে যাওয়া অবধি’ প্রতিটি ছবি রঙ তুলিতে ফুটিয়ে তুলেছে তারা।
এই বিশাল কর্মযজ্ঞে ছিলেন ৪ আয়োজক বগুড়া জিলা স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী মশিউর শাফি, নূর মোহাম্মদ নাহিদ, ইসতিয়াক আহম্মেদ, ইনতিশার রহমান। রঙ তুলির ১২ জন হলেন, রিসাদ জামান, ফাইয়াজ রুপান্তর, মুশরাত মাহা, রাইয়্যা খায়ের হাফসা, রাফিয়া খায়ের রিম্মি, মানসুরা, নুজহাত তন্বী, সোহেল, মেহেদী হাসান সিয়াম, গোলাম নিয়ামত কাদির, ওলি ও তাসনিম চূড়া।
এই দেয়ালিকার থিম ধরা হয়েছে বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে। চিত্রটি এক কোনায় শুয়ে দুরবিন দিয়ে আবরার ফাহাদ দেখছেন, ‘বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আবু সাইদ, এই বুঝি গুলিতে লুটিয়ে পড়বেন মাটিতে, আরেক পাশে মীর মুগ্ধ হাতে পানির বোতল নিয়ে ডাকছে, কারও পানি লাগবে? পিচঢালা পথ ভেসে যাচ্ছে এক শিক্ষার্থীর বুকের তাজা রক্তে, পুলিশ মুখ চেপে ধরেছে বৈষম্যের প্রতিবাদ রুখে দিতে, আধমরা ছেলেটাকে ফেলে দেয়া হলো সাঁজোয়া যান থেকে, আন্দোলনকে স্যালুট জানাচ্ছে রিকশাচালক, পাশেই রক্তাক্ত নিথর দেহ নিয়ে যাচ্ছে রিকশার পাটাতনে, অ্যাডভোকেটরা ছুটলেন আদালতে, ডিবি অফিসের লিখিত স্ক্রিপ্ট পড়ানো হচ্ছে কোটা বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের।
তারপর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন রূপ নিল একদফা দাবিতে, উত্তাল হলো সারাদেশ, রক্ত ঝরলো মাটিতে। হেলিকপ্টারে করে পালিয়ে গেলেন শেখ হাসিনা। পতন ঘটল হাসিনা সরকারের। গণ মানুষের জোয়ারের টান গণভবন ও সংসদ ভবনের দিকে, নতুন দিগন্তের সূর্যোদয় হলো বাংলার বুকে, শিক্ষার্থীরা নাম দিল ৩৬ জুলাই স্বাধীনতা ২.০।’
আয়োজকরা বলছেন, ২০১৮’তে সত্য বলায় যে আবরার ফাহাদ আকাশের তারা হয়েছিলেন, যে স্বপ্ন দেখিয়ে ছিলেন – সেই আবরার ফাহাদকে থিম ধরে বগুড়া জিলা স্কুলের ভিতরে সহশিক্ষা কার্যক্রম ভবনের পশ্চিম পাশের দেয়ালে গত ৮ জুলাই কোটা বিরোধী আন্দোলন থেকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতন সবকিছু বন্দি করা হয়েছে রঙ তুলির আঁচড়ে। বগুড়া জিলা স্কুলের ভিতরে করা এই রঙ তুলিতে ২৪ এর স্বাধীনতার সকল কিছু একফ্রেমে, যা দেশের মধ্যে এটি প্রথম বলে দাবি করেছেন আয়োজকরা।
রঙ তুলির আঁচড় দিতে গিয়ে বারবার বুক কেঁপে উঠেছে জিলা স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফাইয়াজ রুপান্তরের। ফাইয়াজ রুপান্তর বলেন, যখন ছবিগুলোর থিম ধরে-ধরে তুলির আঁচড় দিচ্ছি, বুকটা কেঁপে উঠছিল আর সেদিনগুলোর কথা মনে পড়ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নুজহাত তন্বী বলেন, কোটা আন্দোলনে শুরুতে ভাল ছিল। পরের দিকে হলে থাকতে ভয় লেগেছে, ওই সময়গুলো আতঙ্কে কেটেছে। ছাত্রী হল বন্ধ হলো। ঠিকঠাক বাসায় আসতে পারব কিনা, জীবনে শঙ্কা।
আরেক শিক্ষার্থী রাফিয়া খায়ের রিম্মি বলেন, আমরা বুঝাতে চেয়েছি, যে আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। সেই কষ্টকর মুহূর্ত ও বিজয়ের আনন্দের মুহূর্ত। ২৪ এর যে বিজয় তা এই দেয়ালে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আর এই কাজের সাথে যুক্ত হয়ে আমাদের খুব ভাল লাগছে।
আয়োজকরা বলেন, আমরা চিন্তা করি সবগুলো ছবি মিলিয়ে একটা বিশাল দেয়ালিকা করার। তখন জিলা স্কুলের এই দেয়ালটি ঠিক করা হয়। তারপর ১৪ আগস্ট সকাল থেকে ২০ আগস্ট সন্ধ্যায় গিয়ে পূর্ণ রূপ পায় এই দেয়ালটি। যেখানে ৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট অবধি সব কিছু তুলে ধরা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বগুড়ার সাতমাথা, গণভবন, সংসদ ভবনসহ সকল বিষয়। বগুড়া জিলা স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা এই দেয়ালের নাম দিয়েছেন “দ্য গ্রেট ওয়াল”।