২০২৪ সালে ছিল বিশ্বের মানুষ জন্য ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে ও যুদ্ধের বিষবাষ্প। দেশে দেশে সংঘাতে মৃত্যুর মিছিল বারি হয়েছে। মনে হয়েছে মানুষই আজ মানুষের বড় শত্রু। মৃত্যুর হাত থেকে রেহায় পায়নি নিষ্পাপ শিশুরাও। কোন কোন দেশে গণ অভ্যুত্থানে নাড়িয়ে দিয়েছে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিতও।
২০২৪ সালে বিশ্বের আলোচিত নানা ঘটনা-
বাংলদেশের মসনদে ফের শেখ হাসিনা: ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন। তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে নির্বাচন ভোট বয়কট করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে আমেরিকা। কিন্তু সমস্ত কিছু নস্যাৎ করে বিপুল জনসমর্থন পান হাসিনা। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ফের সরকার গড়ে তাঁর দল আওয়ামী লীগ। ১০ জানুয়ারি টানা চতুর্থবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন মুজিবকন্যা।
গদিচ্যুত শেখ হাসিনা: নির্বাচন জেতার আট মাসের মধ্যেই গদিচ্যুত হন শেখ হাসিনা। ৫ আগস্ট শিক্ষার্থী-জনতার গণ অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেশ ছাড়েন মুজিবকন্যা। এরপর ৮ আগস্ট বাংলাদেশের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার।
জাপানে ভূমিকম্প: ১ জানুয়ারি, ২০২৪। বিভিন্ন দেশ যখন বর্ষবরণের আনন্দে মেতে ওঠে সেসময়ই প্রকৃতির রুদ্ররোষে পড়ে জাপান। বছরের প্রথম দিনেই ৭.৬ মাত্রার তীব্র ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে উদীয়মান সূর্যের দেশ। আঘাত হানে সুনামিও। প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রাণ হারান শতাধিক মানুষ, ক্ষয়ক্ষতিও হয় বিস্তর।
তাইওয়ানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন: ১৩ জানুয়ারি তাইওয়ানের নতুন প্রেসিডেন্ট হন লাই চিং তে ওরফে উইলিয়াম লাই। তার এই জয়ে অস্বস্তি বাড়ে চিনের। বরাবরই অভিযোগ ছিল, এই নির্বাচনে কলকাঠি নাড়ছে বেজিং। তাইপেইতে নিজের পছন্দের প্রেসিডেন্ট চাইছিল কমিউনিস্ট দেশটি। আর সেই কারণেই লাইকে ‘বিপজ্জনক বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বলে প্রচার চালিয়েছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত শেষ হাসি হাসেন শাসক ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টির নেতাই। এর আগে তিনিই ছিলেন তাইওয়ানের ভাইস প্রেসিডেন্ট।
পাকিস্তানে নির্বাচন: লাগাতার নাশকতার মধ্যেই ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় নির্বাচন। জেলে বসেই আমজনতার জন্য বিশেষ বার্তা দেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ভোটের ফল গণনার পর দেখা যায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে, শাহবাজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন)। সবচেয়ে বেশি আসনে জয় পান ইমরানের দল পিটিআই সমর্থিত নির্দলরা। কিন্তু নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকার কারণে তারা সরকার গঠন করতে পারেননি। ফলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন শেহবাজ শরিফ।
অ্যালেক্সেই নাভালনির মৃত্যু: ১৬ ফেব্রুয়ারি মৃত্যু হয় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পয়লা নম্বর ‘শত্রু’ অ্যালেক্সেই নাভালনির। রাশিয়ার ফেডারেল জেল বিবৃতি জারি করে জানায়, হাঁটতে বেরিয়েছিলেন নাভালনি। তখনই অসুস্থতা বোধ করেন রাশিয়ার বিরোধী নেতা। খানিকক্ষণের মধ্যেই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে যান তিনি। দ্রুত অ্যাম্বুল্যান্স টিম হাজির হয় ঘটনাস্থলে। সেই দলই তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করে। তারপর থেকেই সরগরম হয়ে ওঠে রাশিয়ার রাজনীতি। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের খুনের অভিযোগ তোলে নাভালনির পরিবার।
রাশিয়ায় নির্বাচন: ১৭ মার্চ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় রাশিয়ায়। ফলপ্রকাশের পর দেখা যায় ভ্লাদিমির পুতিনের ঝুলিতে রয়েছে ৮৭.৮ শতাংশ ভোট। ফলে বিপুল জনসমর্থন পেয়ে ফের একবার রাশিয়ার মসনদে বসেন পুতিন। টানা পঞ্চমবার প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন তিনি। ইউক্রেন যুদ্ধ, বিরোধী নেতা নাভালনির মৃত্যু কোনও কিছুই প্রভাব ফেলেনি নির্বাচনে। ১৯৯৯ সাল থেকে রাশিয়ার মসনদে রয়েছেন পুতিন। এবারেও রেকর্ড ভোটে জিতে ২০৩০ পর্যন্ত ক্ষমতায় রাশ ধরে রাখলেন তিনি। এই মেয়াদ যদি শেষ করতে পারেন তাহলে রাশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে প্রেসিডেন্ট থাকার নজির গড়বেন পুতিন। টপকে যাবেন জোসেফ স্ট্যালিনকেও।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত: ১ এপ্রিল সিরিয়ার দামেস্কে ইরানের দূতাবাসে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়। প্রাণ হারান অন্তত ১৩ জন। মৃতদের মধ্যে ছিলেন তিন ইরানি সেনাকর্তাও। এই হামলার পিছনে ইজরায়েলকে দায়ী করে তেহরান। লাগাতার সতর্কবার্তার পর ১৩ এপ্রিল ইজরায়েলে একের পর এক মিসাইল ছুড়তে শুরু করে ইরান। সব মিলিয়ে ৩০০টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়। ১৯ এপ্রিল ইসলামিক দেশটিকে পালটা মার দেয় ইজরায়েলি ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ)। তীব্র বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে ইরানের একাধিক শহর। ছড়িয়ে পড়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আতঙ্ক।
তাইওয়ানে ভূমিকম্প: ৩ এপ্রিল ভয়াবহ ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে তাইওয়ান। রিখটার স্কেলে তীব্রতা ছিল ৭.৪। মৃত্যু হয় প্রায় ১০০ মানুষের, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও ব্যাপক। তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে বড় বড় হোটেল। ফাটল ধরে একাধিক সড়কে। গত ২৫ বছরের মধ্যে এটাই তাইওয়ানে হওয়া সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প।
বন্যায় বিধ্বস্ত ব্রাজিল: ৫ মে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে ব্রাজিল। সঙ্গে দোসর প্রবল বর্ষণ। প্রকৃতির রুদ্ররোষে মৃতের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যায় এবং বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হন প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ। প্লাবনে তলিয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম। বন্যার জেরে ব্রাজিলের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ রিও গ্র্যান্ডে ডো সুলে পানির তলায় চলে যায়। এই প্রদেশের রাজধানী তথা ব্রাজিলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর পোর্তো আলেগ্রের অবস্থা ছিল সবচেয়ে খারাপ। সব মিলিয়ে অন্তত ৪৯৭টি শহর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গত ৮০ বছরের মধ্যে এটাই ছিল ব্রাজিলের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা।
ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যু: ১৯ মে কপ্টার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। জানা যায়, আজারবাইজানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আরস নদীর উপরে একটি বাঁধ উদ্বোধন করার কথা ছিল রাইসির। সেই কর্মসূচিই ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনে। একটি পার্বত্য অঞ্চল পেরিয়ে যাওয়ার সময় কপ্টারটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উত্তর-পশ্চিম ইরানের একটি পাহাড়ে আছড়ে পড়ে। এই দুর্ঘটনায় ইজরায়েলের দিকে ষড়যন্ত্রের আঙুল ওঠে। কিন্তু সমস্ত অভিযোগ উড়িয়ে দেয় তেল আভিভ।
ঋষি সুনাকের পরাজয়: ৫ জুলাই ব্রিটেনের নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হয়। নজির গড়ে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন কেয়ার স্টারমার। তাঁর দল লেবার পার্টির কাছে ভরাডুবি হয় কনজারভেটিভ পার্টির। প্রধানমন্ত্রীর গদি হারান ঋষি সুনাক। ১৪ বছর পর টোরি শাসনের অবসান ঘটে রাজার দেশে।
ইরানে নির্বাচন: ইব্রাহিম রাইসির আকস্মিক মৃত্যুর পর নির্বাচন হয় ইরানে। ৬ জুলাই নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন সংস্কারপন্থী নেতা মাসুদ পেজেস্কিয়ান। জোর টক্কর দিয়ে তিনি পরাজিত করেন কট্টরপন্থী নেতা সাইদ জালিলিকে। পেজেস্কিয়ানের শপথগ্রহণে গিয়েই গুপ্তঘাতকের হাতে তেহরানে মৃত্যু হয় হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়েহর। এই খুনে অভিযোগের আঙুল ওঠে ইজরায়েলের দিকে।
লেবাননে হামলা ইসরায়েলের: ১৯ সেপ্টেম্বর পেজার বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে লেবানন। সশস্ত্র সংগঠন হেজবোল্লার সদস্য-সহ প্রাণ যায় অন্তত ৫০০ জনের। আহতের সংখ্যা ৪ হাজার পেরিয়ে যায়। এই ঘটনার পরদিন থেকেই লেবাননে হামলা শুরু করে ইজরায়েল। ২৭ সেপ্টেম্বর ইজরায়েলি সেনার অভিযানে নিহত হন হেজবোল্লা প্রধান হাসান নাসরাল্লা। কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁর উত্তরসূরি হাশেম সাফেদ্দিনকেও খতম করে তেল আভিভ। নয়া কমান্ডার হিসাবে নাইম কাসেমের নাম ঘোষণা করে হেজবোল্লা। এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে ইরানও।
ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন: ৫ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় আমেরিকায়। শুরুতে ৮২ বছরের জো বাইডেনকে প্রার্থী হিসেব বেছে নিয়েছিল ডেমোক্র্যাট। কিন্তু পরে ভোটের লড়াই থেকে সরে যান বাইডেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে শামিল হন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। কিন্তু ফলাফল প্রকাশ হতে দেখা যায় কমলাকে অনেকটা পিছনে ফেলে দিয়েছেন বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প। নির্বাচন জিতে দুরন্ত প্রত্যাবর্তন ঘটান তিনি।
বাশার আল আসাদের পতন: ২৭ নভেম্বর সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ ভয়ংকর রূপ নেয়। আল কায়দার শাখা সংগঠন হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) নেতৃত্বে আলেপ্পো দখল করে নেওয়ার ঘোষণা করে বিদ্রোহীরা। তারপর একে দারা, হোমসের মতো গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করার পর ৮ ডিসেম্বর রাজধানী দামাস্কাসে পৌঁছয় বিদ্রোহীরা। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বাহিনীকে পিছু হঠতে বাধ্য করে তারা। পতন ঘটে আসাদ পরিবারের ৫৪ বছরের শাসনের।