বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে সন্ত্রাস ও হত্যার ইতিহাস দীর্ঘ ও বেদনাদায়ক; খাগড়াছড়িতে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী ঘটনা তারই অংশ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম ‘এক্সক্লুডেড এরিয়া’ হিসাবে পরিচালিত হওয়ার ফলে এ অঞ্চল সরাসরি ব্রিটিশ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। তখন স্থানীয় পাহাড়ি রাজা ও সম্প্রদায়কে আঞ্চলিক শাসনের অধিকার এবং জমির মালিকানা ও প্রশাসনিক ক্ষমতা মূলত উপজাতীয় সমাজের হাতে রাখা হয়; ফলে তাদের সামাজিক কাঠামো ও স্বায়ত্তশাসন মজবুত ছিল। ব্রিটিশ শাসন শেষে পাকিস্তান আমলেও পার্বত্য অঞ্চলে প্রশাসনিক অবহেলা, বৈষম্য ও শোষণ চলতে থাকে।

১৯৬০-এর দশকে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে হাজার হাজার চাকমা ও অন্যান্য পাহাড়ি লোকজন বাস্তুচ্যুত হয়; অনেকেই ভারতে ও মিয়ানমারে আশ্রয় নেয়। এ বাস্তুচ্যুতি পার্বত্য অঞ্চলে সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে এবং বাস্তুচ্যুতদের মধ্যে গভীর অসন্তোষের বীজ বোনা হয়। স্বাধীনতার পরও পরিস্থিতি পালটায়নি। ১৯৭২ সালে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসন, জমির অধিকার ও সরকারি উন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ নিশ্চিতের দাবি তুলে ধরলেও সংঘাত থামেনি। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ড ও পরবর্তী সামরিক শাসনের সময় পাহাড়ে সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যায়; রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সেনা অভিযান এবং স্থানীয় আওয়ামী নেতাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণে বহু বাঙালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

পরবর্তী কয়েক দশকেও শান্তি অর্জিত হয়নি; ১৯৮০ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে পার্বত্য জেলাগুলোতে শান্তিবাহিনী ও সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের সংঘর্ষে প্রায় ৪০০ সেনা ও ৩০ হাজার বাঙালি নিহত হয়; শত শত পরিবার বাস্তুচ্যুত ও সম্পদ ধ্বংসের শিকার হয় এবং নিরাপত্তাহীনতা দীর্ঘস্থায়ী হয়। ১৯৯৬-৯৭ সালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলে সংঘাত কমার বদলে নতুন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। ঘটনাবলির পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবে স্থায়ী সমাধান আনতে ব্যর্থ হয়েছে; বরং কিছু ক্ষেত্রে এটি প্রশাসনিক বিভাজন, ঘরবাড়ি ভাঙচুর, সম্পদ লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ডকে থামাতে পারেনি এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব বজায় রাখতে সাহায্য করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। চুক্তির প্রক্রিয়ায় ইউপিডিএফ ও জেএসএসকে আত্মনিয়ন্ত্রণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে; অনেক বিশ্লেষক এটাকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন।

এ অঞ্চলের জনসংখ্যাগত ছবিও বিবেচ্য; যেমন, পার্বত্য তিন জেলায় প্রায় ১৪ লাখ মানুষের মধ্যে আনুমানিক ৫৯ শতাংশ বাঙালি ও ৪১ শতাংশ পাহাড়ি বলে প্রচলিত পরিমাপ রয়েছে; আবার অন্য সূত্রে কিছু ভিন্নতাও দেখা যায়, তবে পরিষ্কার যে বাঙালি ও পাহাড়ি উভয়ের উপস্থিতি গঠনগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। হাজার হাজার নিরীহ মানুষের হত্যার বিচার না হওয়ায় অপরাধীরা আরও সাহসী হয়ে ওঠে এবং কিছু ক্ষেত্রে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো রাষ্ট্রীয় আশ্রয়ও পাচ্ছে, যা স্বাধীন দেশের জন্য লজ্জাজনক। একইসঙ্গে শিক্ষাগত দিক থেকেও কিছু পার্থক্য রিপোর্ট করা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা হয়েছে, চাকমা জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষিতের হার তুলনামূলকভাবে উন্নত এবং চাকমা নারীদের মধ্যে শিক্ষকতা পেশায় অংশগ্রহণও উল্লেখযোগ্য। অপরদিকে কয়েকটি এলাকার বাঙালি জনগোষ্ঠীর শিক্ষাগত হার কমে আছে; এসব পার্থক্য প্রশাসনিক নীতিতে এবং উন্নয়ন উদ্যোগের বাস্তবায়নে প্রভাব ফেলে, যেখানে কখনো বাঙালির দুরবস্থা উপেক্ষিত থেকে যায়।

সাম্প্রতিক খাগড়াছড়ি সংঘাতের প্রেক্ষাপটে অভিযোগ উঠেছে, ধর্ষণের একটি নাটক সাজিয়ে সংঘাত উসকে দেওয়া হয়; যদিও মেয়েদের মেডিকেল প্রতিবেদন ও প্রাথমিক তথ্যগুলোতে প্রমাণ মিলেনি, তবু এ ধরনের ঘটনা এলাকায় অস্থিরতা ও সামাজিক উত্তেজনা তৈরি করেছে। এ ধরনের কৌশলগত বিভ্রান্তি ও ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সামগ্রিকভাবে সমস্যাকে জটিল করে তোলে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা ইউপিডিএফের সন্ত্রাস বন্ধে তৎক্ষণিক ও সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেন। গোয়েন্দা ও মাঠ পর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী সূত্রবিহীনভাবে ছড়ানো মিথ্যা অভিযোগ, সীমান্তের বাইরের প্রশিক্ষণ ও সাহায্য ইত্যাদি প্রতিহত করতে হবে। তবে পুরোটাই কেবল শক্তি প্রদর্শন করে সমাধান না করে আইনশৃঙ্খলা বজায় রেখে প্রমাণভিত্তিক তদন্ত, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, ক্ষতিগ্রস্তদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক ঐক্য রক্ষার কার্যকর ব্যবস্থাও প্রয়োজন। একইসঙ্গে সামরিক ও সিভিল প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো জরুরি, যাতে নিরাপত্তা বজায় রেখে জনসাধারণের আস্থা পুনঃস্থাপন করা যায়।

বর্তমানে খাগড়াছড়িসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থিতিশীলতা কমাতে সেনা ক্যাম্প ও ক্যান্টনমেন্ট বাড়ানোর প্রস্তাব উঠেছে; বিশেষত কিছু সম্ভাব্য সুপারিশে খাগড়াছড়িতে ক্যাম্প সংখ্যা ২৫০-তে উন্নীত করার কথা বলা হচ্ছে। ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তির পরে সেনা ক্যাম্প কমানো হয়েছিল, যা নিরাপত্তাহীনতার ভাব প্রকাশ করেছে বলে মনে করা হয়; যদিও কিছু মানুষ মনে করেন, সেনা উপস্থিতি বাড়লেই নিরাপত্তা বাড়বে, অন্যরা আশঙ্কা করেন, এতে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার ক্ষুণ্ন হতে পারে। তাই সেনা ক্যাম্প এবং সেনা উপস্থিতি বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় স্থানীয় মতামত, নিরাপত্তা পরিস্থিতি, আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও মানবাধিকার বিবেচনা করে আসন্ন নীতি গ্রহণ করা উচিত।

সমস্যার মূলে আছে বহুমুখী ও জটিল ভূ-রাজনৈতিক অনুষঙ্গ; নির্দিষ্টভাবে প্রতিবেশী দেশগুলোর দীর্ঘমেয়াদি হস্তক্ষেপ ও সীমান্তসংলগ্ন রাজনৈতিক অবস্থা। তবে এ সংকটকে কেবল জাতিগত বা ধর্মীয় দ্বন্দ্ব হিসাবে ব্যাখ্যা করা হলে বাস্তব সমাধান মিলবে না; এটি মূলত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ও অংশগ্রহণমূলক নীতিনির্ধারণের প্রশ্ন।

সীমান্তের উভয় পাশে সংঘর্ষ প্রবণতা ও স্বাধীনতাবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট রয়েছে; তাই সীমান্ত তত্ত্বাবধান আরও জোরদার, গোপনীয় গোয়েন্দা তথ্য কার্যকরভাবে ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে সমস্যার উৎস নির্ণয় ও সমাধান করা দরকার। একইসঙ্গে গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী সমাজ ও মানবাধিকারকর্মীদেরও দায়িত্ব থাকবে-সব পক্ষের নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিতে কাজ করতে হবে, যাতে আক্রান্ত নিরীহ মানুষের কষ্ট ও ক্ষতি নিরপেক্ষভাবে বিবেচিত হয়। যদি কিছু সংগঠন বা ব্যক্তিরা সীমান্তের পেছনের শক্তির প্রকৃত স্বার্থে কাজ করে থাকে, তা তদন্ত করে আইনি পথে সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে; কিন্তু এ কাজটি করতে গিয়ে সাধারণ জনগণের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হলে তা সমাধান নয়, বরং সমস্যা বাড়াবে।

দেশের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও জাতীয় ঐক্য রক্ষায় উচিত কড়াভাবে সন্ত্রাস দমন করা; তবে সেই প্রক্রিয়ায় মানবাধিকারের প্রতি সম্মান বজায় রাখতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও বাঙালি-সবাই বাংলাদেশের নাগরিক; তাদের জীবন, স্বার্থ ও অধিকার সুরক্ষিত রাখাই রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।

ড. মিজানুর রহমান : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট