মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া রাজনীতির অন্তরালে সন্ত্রাসের গডফাদার। তিনি একজন ঠান্ডা মাথার খুনিও বটে। দুর্নীতির মানসপুত্র এই মায়ারে পরিচয় রয়েছে বিভিন্ন ভাবে। কখনও তিনি জনপ্রতিনিধি আবার কখনও তিনি জন আতঙ্কের নাম।

যদিও মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করেছেন। দেশ প্রেমের স্বীকৃতিও পেয়েছেন। নামের শেষে পদবি বীর বিক্রম। কিন্তু দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে বদলে ফেলেছেন হয়ে উঠেছেন মাফিয়া ডন। নিজেকে যেমন ডন বানিয়েছেন তেমনি সন্তানদেরও সেভাবেই গড়ে তুলেছেন। রাজনৈতিক অর্জনের সবটুকুই ম্লান হয়ে গেছে তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে।

১৯৭৫ সালের জেলহত্যা দিবসে মায়াকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছিল। তিনি ১৯৯২ সাল থেকে ঢাকা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যখন মহানগর ইউনিট গঠিত হয়, ২০১৬ সাল পর্যন্ত। যখন এটি উত্তরে বিভক্ত হয় এবং দক্ষিণ ইউনিট হিসেবে পরিচিতি পায়। ২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর মায়াকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য করা হয়।

মায়া ৭ম সংসদ (১৯৯৬-২০০১) এবং দশম সংসদ (২০১৪-২০১৮) চাঁদপুর-২ আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । তিনি ১৯৯৭-১৯৯৮ সালে স্থানীয় সরকার এবং পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী এবং ১৯৯৮-২০০১ সময় নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তিনি ২০০৩ এবং ২০০৪ সালে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০০৪ সালে ঢাকায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনায় মায়া উপস্থিত ছিলেন ।

২০০৭-এ ৫ অক্টোবর, মায়া এবং তার পরিবারের চার সদস্য তার স্ত্রী, দুই ছেলে এবং এক পুত্রবধূর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। মায়া যখন নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন তখন টাকা নেওয়া এবং ঘোষণা না করার অভিযোগ আনা হয়েছিল। ২০০৮-এ ফেব্রুয়ারি, মায়াকে অভিযোগের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং তাকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ৫৯ মিলিয়ন টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় আর ৫০ মিলিয়ন টাকা জরিমানা করা হয়। তার পরিবারের সদস্যদের বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। মায়া বিচারের সময় দেশের বাইরে ছিলেন এবং তার দল ক্ষমতায় ফিরে না আসা পর্যন্ত তিনি ফিরে আসেননি।

২০০৯ সালের ২০ মে, তিনি ঢাকার আদালতে আত্মসমর্পণ করেন এবং তাকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু ২০১০-এ ২৭ অক্টোবর মামলার আপিল জেতার পর তাকে মুক্তি দেওয়া হয়, যখন বিচারকরা তাকে অভিযোগ থেকে খালাস দেন। দুর্নীতি দমন কমিশন ( দুদক) ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টে মামলাটির একটি আপিল দায়ের করে, যা ২০১৫ সালের ১৪ জুন আপিলের সিদ্ধান্তকে প্রত্যাহার করে। মায়ার একটি আপিলের পরে, ২০১৬ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট অভিযোগগুলি বহাল রাখে। ২০১৮ এ অক্টোবর, হাইকোর্ট আবার সেই মামলায় মায়াকে খালাস দেন।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের টিকিট পান। এসময় নির্বাচনকে অধিক গ্রহণযোগ্য করতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেন। এই সুযোগে মায়ার বিরুদ্ধে নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ইশফাক আহসান। তার ক্লিন ইমেজের কারণে দলটির একটি বৃহত্তর অংশ মায়ার পরিবর্তে ইশফাক আহসানকে সমর্থন করেন। আর এই সমর্থন কাল হয় আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের জন্য। এরপর বিভিন্ন সন্ত্রাসী কায়দায় ভোট চুরি করে মায়া চৌধুরী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আর নির্বাচিত হয়েই তিনি হামলে পড়েন দলের ত্যাগী নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে। তার জিঘাংসার শিকার হন মোহনপুর পর্যটন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মিজানুর রহমান। কাজী মিজানুর রহমান নিজে একজন জনপ্রিয় ব্যক্তি।

মায়া চৌধুরীর রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে তিনি বিপুল ভোটে মোহনপুর ইউপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। নির্বাচনের পরপরই মায়া চৌধূরী এবং তার সমর্থকরা কোন ধরনের যৌক্তিক কারণ ছাড়াই কাজী মিজানের বিরোধিতায় নামে। যখন কোনোভাবেই কাজী মিজানের চরম জনপ্রিয়তাকে ম্লান করা যায়নি তখন মায়া চৌধুরী দাবার গুটি ভিন্নভাবে চালাতে থাকেন। এরই মধ্যে নিজে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে একচ্ছত্র ক্ষমতা মালিক বনে যান। তখন আইন আদালত প্রশাসন সবই নিজের দখলে নেন। ন্যায় বিচার পাওয়ার পরিবর্তে মায়া চৌধুরীর নির্ধারিত বিচার এলাকায় একমাত্র নিয়ামক হয়ে ওঠে। যেহেতু ক্ষমতায় অবৈধ হাসিনা সরকার আর তার প্রিয়পাত্র এই মায়া চৌধুরী সেই হিসেবে পুরো মতলব উত্তর এবং দক্ষিণ তথা চাঁদপুর ২ আসনের পাট্টা লাভ করেন।

এসময় মায়ার বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই কেয়ামতের অবস্থা সৃষ্টি হওয়া। তারই সুযোগে কাজী মিজানকে দমাতে তিনি তার সুষ্ঠু মোহনপুর পর্যটন কেন্দ্রটিতে হামলা চালান। নিজের লোকজন দিয়ে এই হামলায় দেশের একমাত্র মিঠাপানির বিজকে কুক্ষিগত করেন। তিনি অবাধে লুটপাট চালিয়ে মোহনপুরকে শ্মশানে পরিণত করেন। এসময় কয়েক কোটি টাকার সম্পদ লুট করে তা আত্মসাৎ করেন। ঘটনার এখানেই শেষ নয় তিনি মোহনপুর পর্যটন র্কর্তপক্ষকে এলাকা ছাড়া করেন। এখানে কর্মরত কয়েকশ মানুষের রুটি রুজি কেড়ে নেন। জীবনের নিরাপত্তার ভয়ে এসব কর্মচারী আর কর্মকর্তারা পর্যটন কেন্দ্র ছাড়তে বাধ্য হন। মায়ার অপকর্ম জাতীর সামনে তুলে ধরতে ঢাকা থেকে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ক্ষতিগ্রস্ত পর্যটন কেন্দ্রের প্রকৃত চিত্র জানতে সেখানে যান।

এই খবর জানা জানি হয়ে গেলে মায়া তার সন্ত্রাসী বাহিনী সাংবাদিকদের পিছনে লেলিয়ে দেন। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাংবাদিকরা থানার সহযোগিতা যান। এমনকি তখন তারা থানাতে যেয়ে নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা চান। কিন্তু মায়ার হাত এতেটাই লম্বা যে থানা প্রশাসন তাদের নিরাপত্তা দিতে অসমর্থ হয়। তখন মায়ার সন্ত্রাসী বাহিনী থানার ভিতর থেকে সাংবাদিকদের অপহরণ করার চেষ্টা চালায়। পুলিশ প্রশাসন অনেকটাই বাধ্য হয়ে মায়ার সহযোগিতা চায়।

এসময় মায়াকে বোঝানো হয় ঢাকার সাংবাদিকের উপর হামলা চালালে সেটি রাজনীতিতে খারাপ দৃষ্টান্ত হবে। এমনকি বিষয়টি অনেকদূর গড়াবে। আগত সাংবাদিকরা সকলেই ডিইউজে বা বিএফইউজে অথবা জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য। এদের বেশ কয়েকজন ডিআরইউ’র সদস্য। সুতরাং বিষয়টি খুবই খারাপ হবে এমনকি তা সামাল দিতে বেগ পেতে হবে হাসিনা সরকারের। তাই প্রশাসন থেকে পরামর্শ দেওয়া হয় তাদেরকে স্বসম্মানে ঢাকাতে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এটিই হবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত।

সেদিন এমন কথার কারণে মায়া চৌধুরী তার পেটুয়া বাহিনীকে নির্দেশ দেন যেন সাংবাদিকরা ঢাকায় নিরাপদে ফিরতে পারেন। তবে শর্তজুড়ে দেন কোনোভাবেই তার অপকর্মের বয়ান সাংবাদিকরা লিখতে বা বলতে পারবেন না। এভাবেই আইন কাঠামোকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন মায়া চৌধূরী। গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারে পতন আর তার দেশত্যাগের পর থেকে প্রচণ্ড দাপুটে এই মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়রা কোন খোঁজ মিলছে না। সূত্র: খবর সংযোগ