বিশ্বে বসসাসে অনুপোযোগী শহর ঢাকা। প্রতিদিন এ শহরে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গাড়ির সংখ্যা। শহরের প্রতিটি ভবনে পার্কিং ব্যবস্থা কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে তার কোনো চিত্র দেখা যায় না। তবে, কিছু ভবনে পার্কিং ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু তুলনামূলক অনেক কম। এই ব্যস্ততম শহরের অলিগলিতে প্রায় সময় গাড়ি পার্কিংয়ের চিত্র চোখে পড়ে। এর ফলে রাজধানীতে বাড়ছে যানজট।

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, ঢাকায় ৩০ শতাংশ যানজটের জন্য যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং দায়ী। চলাচল করা ৮০ শতাংশ গাড়িই পার্ক করা হয় রাস্তার ওপরে। এ জন্য প্রতি বছর অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এমন বাস্তবতায় গণপরিবহনকে প্রাধান্য দিয়ে প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক পার্কিংয়ের পথে হাঁটতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

ট্রাফিক সিগনাল মেনে চলার বার্তা শোভা পাচ্ছে স্কুলের দেয়ালে। ঠিক তার পাশেই মূল সড়কের ওপর একাধিক লেনে পার্কিং করে রাখা গাড়ি। রাজধানীতে প্রাত্যহিক বাস্তবতা এটি।

পথচারীরা জানান, সড়কের পাশে স্কুল দিয়েছে কিন্তু পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নেই। প্রতিষ্ঠানের নিজেদের পার্কিং না থাকলে কিছু করার নেই। তখন সড়কের ওপরেই গাড়ি রাখতে হয়। রাজউক থেকে সেন্ট্রাল কোনো পার্কিং বিল্ডিং হতে পারে। এই বিল্ডিং থেকে হাঁটার রাস্তা ৫ থেকে ৬ রমিনিটের হতে পারে।

নিয়ম বহির্ভূত গাড়ি পার্কিং বন্ধ করা ও যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা আনতে, ২০১৯ সালে পার্কিং নীতিমালা করে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ। এতে বলা হয়েছে, পার্কিং করতে হবে নির্ধারিত স্থানে। বহুতল পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে জনবহুল ও বাণিজ্যিক এলাকায়। কেবল চিহ্নিত করা সড়কেই রাখা যাবে গাড়ি। মেনে চলতে হবে ভবন নির্মাণ নীতিমালায় পার্কিং এর জায়গা রাখার বাধ্যবাধকতা। বলা বাহুল্য, কাজীর গরু কেতাবে থাকার মতো এসবের বাস্তবায়নও অদৃশ্য।

নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ২০২৮ সালে মার্কেট বিল্ডিংয়ে পার্কিং বাধ্যবাধকতা করেছিলাম। কিন্তু বিপণিবিতানগুলো সামনের সড়কটি পার্কিংয়ের জন্য ব্যবহার করে এবং স্থানীয়দের ম্যানেজ করে চলে। প্রতিটি ভবন মনিটর করতে না পারলে, অবৈধ পার্কিং হচ্ছে কি না এটি যদি মনিটর করা না যায় তাহলে শহর চলবে না।

৯ বছর আগে রাজধানীতে প্রথম মেকানিক্যাল পার্কিং ব্যবস্থা চালু হয় মৎস্য ভবনে। পরে আরও ৬টি জায়গায় এমন ব্যবস্থা চালু হলেও, এর সবগুলোই সরকারি কাজে ব্যবহার হয় সুযোগ নেই সাধারণ ব্যবহারের।

এমন ব্যবস্থাকে সমাধান মানছেন বিশেষজ্ঞরাও। বলছেন, সরকারি-বেসরকারি অংশিদারিত্বে বাণিজ্যিকভাবে এলাকাভিত্তিক হতে পারে এমন পার্কিং। বিশেষ করে সরকারি মার্কেটগুলোতেই নির্দিষ্ট পার্কিং ব্যবস্থা নেই। আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিংয়ের জায়গায় অবৈধ দোকান তৈরি করে ভাড়া দেয় কেউ কেউ।

রাজধানীর ব্যস্ততম গুলিস্তান ও পল্টন এলাকায় এসব মার্কেটের গাড়ি সড়কের ওপর পার্কিং করে রাখার কারণে সড়ক সংকুচিত হয়ে পড়ে। ফলে প্রতিদিনই দীর্ঘ সময় যানজট লেগে থাকে এ এলাকায়। তা ছাড়া হাতে গোনা দুই-চারটি মার্কেট ও শপিং কমপ্লেক্স ছাড়া বেশির ভাগ বাণিজ্যিক স্থাপনাতেই পার্কিং ব্যবস্থা নেই।

বাণিজ্যিক এলাকা কিংবা মার্কেটের সামনের রাস্তায় চোখে পড়ে অবৈধ গাড়ি পার্কিংয়ের দৃশ্য। ফুটপাথ থেকে শুরু করে যেখানে-সেখানে রাখা হয় এসব গাড়ি। সুবিধামতো পার্কিংয়ের জায়গা না থাকায় যত্রতত্র গাড়ি রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকেন চালকরা। সড়ক দখল করে গড়ে তোলেন পার্কিং স্টেশন। পল্টনের মুক্তাঙ্গনের মতো ব্যস্ত এলাকার সামনে সাইনবোর্ড টাঙিয়েই পার্কিং করে রাখা হয় প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাস।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আঞ্চলিক কার্যালয় থাকলেও পার্কিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। সড়কের ওপর বেশ কয়েকটি খুঁটি বাসিয়ে পার্কিংয়ের জায়গা করা হয়েছে। শুধু ডিএনসিসিই নয়, এ এলাকায় জনতা টাওয়ার থেকে পেট্রোবাংলা পর্যন্ত পুরো সড়কের ওপর গাড়ি পার্কিং করে সবাই।

মতিঝিল ও দিলকুশা এলাকায় দেখা গেছে, প্রতিটি সড়কের অলিগলিতে রাখা হয়েছে ছোট-বড় গাড়ি। যার কারণে পুরো এলাকায় যানজট লেগে থাকে। দিলকুশায় সাধারণ বীমা টাওয়ারে ২০০৬ সালে পার্কিং ব্যবস্থা চালু করা হলেও সেখানে গাড়ি রাখা হয় না। অথচ ব্যস্ত সড়কের দুই পাশে হাজার হাজার গাড়ি দিনভর রাখা হয়। ৩৭ তলা সিটি সেন্টারেও প্রায় সাড়ে ৫শ গাড়ি পার্ক করার ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানেও গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য তোলা হয় না।

গুলশান-২ ডিএনসিসি নগর ভবনের সামনের সড়কেও খুঁটি দিয়ে পার্কিংয়ের জায়গা তৈরি করা হয়েছে। ডিএসসিসি নগর ভবনে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। কর্মকর্তাদের গাড়িতেই পূর্ণ হয়ে যায়। তা ছাড়া সচিবালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকাতেও পর্যাপ্ত পার্কিং ব্যবস্থা না থাকায় সড়কের ওপর গাড়ি রাখা হয়।

এ ছাড়া সেগুনবাগিচা, কাকরাইল, নয়াপল্টন, ফকিরাপুল, ফুলবাড়িয়া, মগবাজার, ফার্মগেট, তেজগাঁও, সাতরাস্তা, মেয়র আনিসুল হক সড়ক, বনানী, গাবতলী, টেকনিক্যাল, মিরপুর ১ ও ১০ নম্বর, ধানমন্ডি, গুলশান, বাড্ডা ও নতুনবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় সড়কের ওপর গাড়ি রাখা হয়।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. হাদিউজ্জামান বলেন, মেকানিক্যাল পার্কিংয়ে ট্রে থাকে। এখানে গাড়িচালক ট্রেতে গাড়িটি রেখে বাটন চাপলে সেটি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে পার্কিং স্লটে চলে যাবে। এখানে সবচেয়ে সুবিধার বিষয় হচ্ছে এই পার্কিং স্লটটি চাইলে সিরিয়ে অন্য কোথাও স্থাপন করা সম্ভব। দেখা গেল যেখানে এই স্লটটি রাখা হয়েছে সেখানে গাড়ি পার্কিংয়ের চাহিদা তেমন নেই। তখন সেটি অন্য কোথাও ৭ দিনের মধ্যে স্থাপন করা সম্ভব।

ঢাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে রাস্তা আছে প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার। এতে ৫ থেকে ৬ লাখ যানবাহন ভালোভাবে চলার সক্ষমতা থাকলেও এখন চলে প্রায় ২০ লাখ।