ছাত্র-জনতার অভুত্থানে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করে প্রাণভয়ে ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর ফলে ১৬ বছরের নেতৃত্বের অবসান ঘটে। ক্ষমা চাওয়ার মানসিকতা নেই বলেই দলের এমন সম্ভ্রান্ত, মধ্যম পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র বিভক্তি প্রকাশ পাচ্ছে।

নেতাকর্মীদের দাবি, কোথায় ভুল হয়েছে তা পেছন ফিরে দেখা দরকার আওয়ামী লীগের।
এটাই একমাত্র পথ। ৭৫ বছর বয়সী এই রাজনৈতিক দলটি তাদের সমস্যার সমাধান করে ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে। এ বিষয়ে অনেক নেতাকর্মী কথা বলেছেন।

জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলন, যা পরে পুলিশের সহিংসতায় রূপ নেয়, এক বড় ধাক্কা হয়ে দাঁড়ায় আওয়ামী লীগের জন্য। এই আন্দোলন থেকে শুরু হওয়া গণ-অভ্যুত্থানে দলের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং আওয়ামী লীগের ওপর ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। আন্দোলনের নেতারা, যারা শুরুতে সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, পরে এই আন্দোলনটি দেশব্যাপী বিস্তৃত হয়ে যায়। পুলিশ গুলি চালিয়ে ছাত্রনেতা আবু সাঈদের হত্যার পর, আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত অবিচলিত এবং এটি দলের জন্য বড় ধরনের সংকট তৈরি করে।

আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রংপুরে ছাত্র হত্যার খবর পেয়ে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা তখনও তাদের কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিলেন এবং খেয়ালই করেননি, দেশে কী হচ্ছে। তাদের মধ্যে একজন নেতা তার অফিসে কবিতা শোনাচ্ছিলেন, আর পরে যখন আন্দোলনের খবর পেলেন, তিনি জানিয়ে দেন, ‘নেত্রী সব ঠিক করে ফেলবেন’, অর্থাৎ তাদের কাছে মনে হচ্ছিল, আন্দোলনের কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হবে না। তবে মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে যায়। ছাত্রদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া গণ-অভ্যুত্থান এক ভয়াবহ রূপ নেয়, যেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর দমনপীড়নে অন্তত ৮৩৪ জন নিহত হয় এবং ২০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়। এই সহিংসতার মধ্যে দেশব্যাপী ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়, এবং ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা তার সরকারি বাসভবন ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান, যার ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।

আওয়ামী লীগের নেতা আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম আল জাজিরাকে বলেছিলেন, তাদের দল আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। তবে তিনি নির্দিষ্ট কোনো দেশ বা শক্তির নাম উল্লেখ করেননি। তার এই বক্তব্যে দলের ব্যর্থতার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করা হয়েছে, যা আরও বিশ্লেষকদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দলটি তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেয়নি, এবং এর ফলস্বরূপ, তাদের দলের সাংগঠনিক কাঠামো এক ধরনের ভাঙনে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীরা বিভক্ত এবং নিজেদের মধ্যে একে অপরকে দোষারোপ করতে শুরু করেছে। অনেক নেতা, যারা দীর্ঘদিন ধরে দলের সাথে যুক্ত ছিলেন, এখন মনে করছেন যে, দলটি তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এবং তাদের পাশে নেই।

দলের ভেতরে বিভক্তি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া নিয়ে হতাশা ফুটে উঠেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, দলের অভ্যন্তরীণ সংকট এবং তাদের মনোভাব জনগণের ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে, যা শেষ পর্যন্ত গণ-অভ্যুত্থানকে সফল হতে সাহায্য করেছে। আওয়ামী লীগের এই সংকটে, তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতকে ঘিরে নানা প্রশ্ন উঠেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দলটি পুনর্গঠনের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে। ২০২৪ সালের ২৩ অক্টোবর শান্তিতে নোবেল জয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করে। এই সময়, আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশে হতাশা দেখা দেয়। তারা সরকারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তোলেন। বিশেষ করে, ২০১৪ সাল থেকে আওয়ামী লীগে সুযোগ সন্ধানীরা এবং স্থানীয় এমপিদের পরিবার সদস্যরা তৃণমূল পর্যায়ে আধিপত্য বিস্তার করেছে, যা দলটির অভ্যন্তরীণ সংকট আরো বাড়িয়েছে।

এদিকে, আওয়ামী লীগের নেতারা নিজেদের ব্যর্থতা নিয়ে এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা করেননি। বরং, তারা আন্দোলনকে ‘সন্ত্রাসী অভ্যুত্থান’ হিসেবে উল্লেখ করেছে, যা দলের মধ্যে আরও বিভাজন তৈরি করেছে। যুবলীগের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কোটা বিরোধী আন্দোলনের পেছনে জামায়াত-শিবিরের হাত ছিল, যা সরকারের মতে দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আওয়ামী লীগ আরও দাবি করেছে যে, কোটা বিরোধী আন্দোলন পাকিস্তানি আদর্শের দিকে নিয়ে যেতে চায়।

অন্যদিকে, বিএনপি এবং জামায়াত, যারা দীর্ঘদিন ধরে সরকারের নিপীড়নের শিকার, তারা দাবি করছে, যে নেতা বা কর্মী হত্যাকাণ্ড ও গুমের সাথে জড়িত, তাদের বিচারের মুখোমুখি করা উচিত। তাদের মতে, আওয়ামী লীগ সরকার একমাত্র জনগণের কাছে বিচারিত হতে পারে। ছাত্র আন্দোলনের একজন নেতা মাহফুজ আলম বলেন, আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হবে না, কারণ তারা গণহত্যা ও নির্যাতনের জন্য দায়ী।

এখন প্রশ্ন উঠেছে, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভবিষ্যত কী হবে? বিশ্লেষকরা বলছেন, দলটি এখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং সংস্কারের মধ্য দিয়ে ফিরে আসতে পারবে, তবে তা কঠিন। তাদের পুনর্গঠন এবং জনগণের বিশ্বাস অর্জন করতে হলে, তারা প্রথমে নিজেদের ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে এবং নিজের নেতাদের পদত্যাগের বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।

বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের ছেলে, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ বলেন, আওয়ামী লীগের উচিত জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং নিজের ভুল স্বীকার করা। তিনি বলেন, এখনো আমি তাদের আত্মসমালোচনা বা ক্ষমা চাওয়ার কোনো চিহ্ন দেখিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্লেষক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তাদের ক্ষমা চাওয়ার ওপর, এবং তাদের বর্তমান আদর্শ পরিত্যাগ করতে হবে। তাদের শাসনামলের সময় ঘটে যাওয়া অপরাধের জন্য তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।

তবে, দলের মধ্যে এখনো কিছু নেতাকর্মী শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা রাখছেন। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দলের পুনর্গঠন এবং সরকারের বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছেন। কিন্তু দেশজুড়ে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে যেই হতাশা দেখা যাচ্ছে, তা দলের ভবিষ্যতের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

অবশ্য, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা একমত যে, শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগকে এখন নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে ফিরে আসতে হবে, যাতে তারা জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে পারে। তাদের কেবল নিজেদের ভুলগুলো মেনে নিয়ে, দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের কাছে ক্ষমা চেয়ে একটি নতুন রাজনৈতিক পথ খুঁজে বের করতে হবে। সূত্র: আল-জাজিরা