মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির তথ্যকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে- এমন মত দিয়েছে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি। সংস্থাটি বলছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি এখন একটি রাজনৈতিক সংখ্যায় পরিণত হয়েছে। প্রবৃদ্ধি নিয়ে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এক ধরনের মোহ সৃষ্টি হয়েছে।

গতকাল অনলাইনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। আরও বক্তব্য দেন- সিপিডির বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান ও গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। এতে সিপিডির মূল্যায়ন তুলে ধরেন সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান। ওই সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রবৃদ্ধির এই হিসাব বাস্তবতার সঙ্গে মিলছে না। বিবিএস বলছে, করোনার মধ্যেও ব্যক্তি বিনিয়োগ গতবারের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে, যা নীতিনির্ধারকদের ভুল বার্তা দিচ্ছে। এত বিনিয়োগ হলে তো ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা রাখার জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ দেওয়ার দরকার হতো না। তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, আমরা ধরে নিচ্ছি এবং বিবিএস যে কথা বলছে, এটা হলো ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন অর্থবছরে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি কত হয়েছে। বিবিএসই বলেছে, ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। যেহেতু চতুর্থ প্রান্তিকে আমাদের একটা নেগেটিভ অবস্থা ছিল, সুতরাং প্রবৃদ্ধির তো প্রশ্নই আসে না। এটা আমরা চ্যালেঞ্জ করতে পারি। কেউ যদি বলে চতুর্থ প্রান্তিকে, গত বছরের চতুর্থ প্রান্তিকের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আমরা দেখেছি, জুলাই-মার্চে (২০১৯ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত) একমাত্র রেমিট্যান্স ছাড়া আমদানি, উৎপাদন, বেসরকারি খাতের ঋণ, ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ সব মিলিয়ে জুলাই-মার্চেই অর্থনীতিতে একটা শ্লথ গতি দেখছিলাম। তারপর যোগ হয়েছে চতুর্থ প্রান্তিক। যেখানে প্রবৃদ্ধির প্রশ্নই আসে না। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে আমরা বলছি ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বাস্তবতার সঙ্গে মিলছে না। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, প্রবৃদ্ধির হিসাব অতিরঞ্জিত করে লাভ নেই। এটা নীতিনির্ধারণে সহায়তা করবে না।

তথ্য-উপাত্ত সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠান বিবিএসের স্বাধীনতা দিন দিন খর্ব করা হচ্ছে। বিবিএসের দেওয়া জিডিপির প্রাক্কলনে করোনার প্রভাব তেমনভাবে প্রতিফলিত হয়নি। জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, সেখানে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা রয়েছে। এগুলো হলো- হিসাব পদ্ধতির মধ্যে অন্তর্নিহিত দুর্বলতা রয়েছে। কারণ আমরা দেখছি, এখানে অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসের ভিত্তিতে এই হিসাবটি করা হয়েছে। ফলে পরবর্তী তিন মাসে অর্থনীতির কী হলো তার কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।’ ‘দ্বিতীয় বিষয় হলো-অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হালনাগাদ নয়। তার মানে নিয়মিতভাবে সেই তথ্যগুলো আহরণ করা হয় না। অনেক তথ্য অনেক পুরনো, তার ভিত্তিতে একটা প্রাক্কলন করা হয়েছে।
তিনি তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার বিষয় সম্পর্কে বলেন, অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসের ভিত্তিতে জিডিপির হিসাব করা হয়েছে। এই অর্থবছরে বাংলাদেশের এবং সারা পৃথিবীতে অর্থনীতিতে করোনার যে প্রভাব পড়েছে, সেই প্রভাবটা ঐতিহাসিক। এটার প্রভাব সর্বব্যাপী। এ প্রভাবটা কিন্তু আমরা জিডিপির হিসাবের মধ্যে তুলে ধরতে পারলাম না। আমাদের দেশে মার্চ মাস থেকে করোনা শনাক্ত হয়েছে। এরপর থেকে লকডাউন দেওয়া হয়েছে। সুতরাং অর্থনীতিতে এর প্রভাবটা শেষ প্রান্তিকে এসে বেশি বোঝা যায়।

তিনি বলেন, অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি শুধু একটা সংখ্যা নয়, এর পেছনে অনেক তাৎপর্য রয়েছে। যেমন মানুষের ওপর প্রভাব, নীতিমালার ক্ষেত্রে প্রভাব। কিন্তু এখন আমরা দেখছি, এটা একটা রাজনৈতিক সংখ্যায় পরিণত হয়েছে। প্রবৃদ্ধির সুফল যদি সবাই না পায়, প্রবৃদ্ধির ফলে যদি কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হয়, দারিদ্র্য না কমে, বৈষম্য না কমে, তাহলে সেই প্রবৃদ্ধি কোনো ধরনের অন্তর্ভুক্তমূলক হয় না। সুতরাং এ সংখ্যা দিয়ে যদি আমরা আমাদের সাফল্য দেখাতে চাই, তাহলে তা কোনো কাজের হবে না।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিবিএসের তথ্য-উপাত্ত দেখে মনে হচ্ছে, করোনার মধ্যে সেবা খাতের পতন ঘটেনি। কিন্তু আমরা জানি, কত মানুষ কর্মহীন হয়েছে। তাদের জন্য সরকারও নানা ধরনের সহায়তা কর্মসূচি নিয়েছে। তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, সরকারের যে পরিসংখ্যানগুলো দেওয়া হয়েছে সেগুলো এবং সরকার অন্যান্য যে কার্যক্রম নিচ্ছে তার সঙ্গে মিলিয়ে আমরা তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি। ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি সরকারের এই হিসাব যদি ঠিক থাকে, তাহলে মাথাপিছু আয় যেটি সরকার বলছে ২০৬৪ ডলার হয়েছে এটা সঠিক হলো, বিভিন্ন সংস্থা যে হারে দারিদ্র্য বাড়ার কথা বলছে, সেহারে বাড়ার কথা নয়। অথবা নতুন দারিদ্র্য সৃষ্টি হওয়ার যে কথা বলা হচ্ছে, সেটাও হওয়ার কথা নয়।

সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন- সেখানে বলা হয়েছে, অর্ধেকের বেশি জিডিপি প্রাক্কলন করার মতো গ্রহণযোগ্য তথ্য-উপাত্ত নেই। বিবিএসের দেওয়া জিডিপির হিসাব বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে একটি পরিসংখ্যান কমিশন তৈরি করার সুপারিশ করেছে সিপিডি। সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন