ঢাকাসহ সারাদেশে এবার করোনার মধ্যেও কোরবানির পশুর হাট বসবে৷ তবে সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, স্বাস্থ্যবিধি যাতে মানা হয় সেদিকে কঠোর নজরদারি করা হবে৷ ডিডাব্লিউ।
কিন্তু জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে মাঠে কোরবানির পশুর হাট বসিয়ে সামাজিক দূরত্ব এবং স্বাস্থ্যবিধি মানানো অসম্ভব৷ গত রোজার ঈদেও দোকানপাট খোলার সময় একই কথা বলা হয়েছে৷ ব্যক্তিগত পরিবহণের নামে মানুষকে ঢাকা ছাড়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে৷ এর কারণে ঈদের পরে করোনার প্রাদুর্ভাবও বাড়তে শুরু করে৷ এবার খোলা মাঠে গরুর হাট বসানো হলে আরো বড় সর্বনাশ হতে পারে বলে মনে করেন তারা৷
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গ্রামীণ অর্থনীতির সাথে কোরাবানির পশুর হাটের একটা যোগ আছে৷ বাংলাদেশের চামড়া শিল্পও অনেকটা নির্ভরশীল কোরাবানির ওপরে৷ তাই দুই দিক রক্ষা করতে এবার কোরাবনির পশুর হাটের জন্য অনলাইন হাট এবং ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেয়া উচিত৷
যেভাবে বসবে পশুর হাট
এবার ঢাকার দুই সিটি মিলিয়ে পশুর হাট বসবে মোট ২৪টি৷ এরমধ্যে উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ১০টি এবং দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় হবে ১৪টি৷ সারা দেশের জেলা উপজেলায়ও পশুর অস্থায়ী হাট বসানোর অনুমতি দেয়া হয়েছে৷ বাস্তবে অনুমোদনের বাইরেও কোরবানিতে আরো অনেক হাট বসে৷ সব মিলিয়ে এই হাটের সংখ্যা সারাদেশে পাঁচ হাজারের কম হবে না৷
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন জানান, ‘‘কোরাবানির পশুর হাটের জন্য স্বাস্থ্য বিভাগ একটি গাইডলাইন তৈরি করছে৷ চূড়ান্ত হলে সেটা অনুসরণ করেই পশুর হাট বসবে৷ আমাদের নিজস্ব টিম এবং মোবাইল কোর্ট থাকবে যাতে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মানা হয়৷’’
অন্যদিকে শুধু পশুর হাট নয়, প্রচলিত পদ্ধতিতে পশু কোরবানিও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াবে৷ কিন্তু ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের এখনও এ বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই৷ ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক বলেন, ‘‘আমরাতো কোরবানির জন্য আলাদা জায়গা করে দেই৷ এর বাইরে কোরবানি করাতো নিষেধ৷ তাই নতুন করে আর কোনো ব্যবস্থার প্রয়োজন নেই৷’’
জানা গেছে, সারাদেশেই কোরবানির হাটের জন্য একটি স্বাস্থ্যবিধি তৈরি করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কাজ করছে৷ তারা বলছেন, পশুর হাটের এখনও অনেক বাকি৷ তার আগেই চূড়ান্ত হবে স্বাস্থ্যবিধি৷ সাধারণত কোরবানির চার-পাঁচদিন আগে পশুর হাট বসে৷ কিন্তু সারাদেশ থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন হাটে পশু নেয়া শুরু হয় তারও এক সপ্তাহ আগে৷ চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ৩১ জুলাই বা ১ আগষ্ট বাংলাদেশে ঈদুল আজহা উদযাপিত হতে পারে৷
পশুর হাটে সর্বনাশের ষোলকলা?
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও প্রিভেনটিভ মেডিসিনের চিকিৎসক ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘‘ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক কারণে কোরবানি ও কোরাবানির পশু বিক্রি বাদ দেয়া যাবে না৷ কিন্তু হাট বসিয়ে পশু বিক্রির ব্যবস্থা করে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সোনার পাথর বাটি৷ এটা যদি করা হয় তাহলে আমি এই করোনায় পশুর হাটেই সর্বনাশের ষোলকলা পূর্ণ হবে বলে মনে করছি৷’’
অন্যদিকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পরিকল্পনা করে করোনায় অর্থনীতি সচল রাখা যেতে পারে৷ কিন্তু এভাবে হাট বাজার খুলে দিলে শেষ পর্যন্ত অর্থনীতিও বাঁচবে না, মানুষও বাঁচবে না৷ তাই বিকল্প ব্যবস্থার কথা বলেন ড. নাজনীন আহমেদ৷ এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘‘এখনও সময় আছে, তাই পরিকল্পনা করে কোরবানির পশুর অনলাইন বাজার শক্তিশালি করতে হবে৷ কৃষক এবং ব্যাপারীদের কাছ থেকে গরু সংগ্রহের চেইন গড়ে তুলতে হবে৷ যেভাবে এবার শাক-সবজি, খাদ্য শস্য সংগ্রহ করা হয়েছে৷’’ যতদূর সম্ভব কসাইখানার ব্যবস্থা করতে হবে৷ গ্রামেও পশু কোরবানির জন্য নিয়ম করে দিতে হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ এর এই গবেষক৷
হাটে কেন এত আগ্রহ?
কোরবানির হাটকে ঘিরে চলে বড় ধরনের বাণিজ্য৷ এরসাথে বিপুল মধ্যস্বত্বভোগী জড়িত৷ হাটের ইজারা, হাসিল, গরুর ট্রাক বা ট্রলার থেকে চাঁদা আদায়ে প্রভাবশালীরা জড়িত থাকেন৷ হাট না বসলে বা কম বসলে তাদের আয়ে টান পড়বে৷ তাই হাট বসানোতে আগ্রহ অনেকের৷
বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরেই অনলাইনে কোরবানির পশুর হাট চালু হয়েছে৷ এছাড়া মাংস বাজারজাত করার আধুনিক প্রতিষ্ঠান এবং খামার গড়ে উঠছে৷ এবার তা আরো সম্প্রসারিত বা জোরদার করা নিয়ে মন্ত্রণালয় ও সিটি কর্পোরেশনের কোনো আগ্রহ নেই৷ সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার বার্ষিক একটি বড় আয়ও আসে কোরবানির গরুর হাট ইজারা দিয়ে৷ স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরাও এই হাট থেকে বেশ আয় করেন৷ ঢাকার দুই সিটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অনলাইন গুরুর হাট নিয়ে তারা চিন্তা করেননি৷
প্রস্তুতি নিচ্ছে ই-কমার্স সাইটগুলো
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এরইমধ্যে কোরবানির অনলাইন পশুর হাট নিয়ে কাজ শুরু করেছে৷ একশরও বেশি অনালইন হাট আছে৷ তবে যাতে প্রতারণা না হয় সেদিকেও তারা জোর দিচ্ছেন৷ সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, ‘‘এবার আমরা অনলাইন হাট ছাড়াও চেষ্টা করছি কোরাবানির পশু জবাই যেন যত্রতত্র না হয় তার ব্যবস্থা করতে৷ হাট বসলে সেখানেই কসাইখানা৷ আর অনলাইনে পশু বিক্রি করলেও তাদের মাধ্যমেই কোরবানির ব্যবস্থা করা৷’’
আগ্রহ কম
বাংলাদেশে প্রতিবছর এক কোটিরও বেশি পশু কোরবানি হয়৷ গত বছর এক কোটি ১০ লাখ পশু কোরবানি হয়েছে৷ তবে এবার কম হতে পারে৷ গরুর ব্যাপারীরা সংশয়ে আছেন৷ ফরিদপুরের দুদু মিয়া প্রতিবছরই গরু নিয়ে ঢাকার শনির আখড়া বাজারে আসেন৷ এবার তিনি এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি৷ তিনি বলেন,‘‘এই করোনার মধ্যে গরু নিয়ে যাব৷ শেষ পর্যন্ত যদি বিক্রি করতে না পারি! এবার যা অবস্থা মানুষের মধ্যে কোরবানি নিয়ে আগ্রহ কম দেখছি৷’’ অন্য ব্যাপারীরা আরো এক সপ্তাহ পর সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানান তিনি৷