করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের সব মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর একসঙ্গে কাজ করছে। এর মধ্যে যে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের কাজ বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম আইসিটি মন্ত্রণালয়। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এই মন্ত্রণালয় বেশ কিছু প্রশংসনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে, যার সুফল জনগণ সরাসরি পাচ্ছে। করোনা সংক্রমণের শুরুতেই নাগরিকদের জন্য করোনাভাইরাস সংক্রান্ত যে কোনো প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও হালনাগাদ তথ্য পেতে করোনা পোর্টাল, করোনা বিডি অ্যাপ এবং কন্টাক্ট ট্র্যাসিং অ্যাপ ‘ভলান্টিয়ার ডক্টরস পুল বিডি’ অ্যাপ : অনলাইনে উচ্চ-ঝুঁকির স্থান চিহ্নিতকরণ এবং ম্যাপভুক্তকরণ, সেলফ টেস্টিং টুল, ‘একদেশ’ ক্রাউন্ডফান্ডিং প্লাটফর্ম : ফুড ফর নেশন এবং ফোনে নিত্যপণ্য : স্বাস্থ্য-সুরক্ষা পণ্য সরবরাহ, করোনাবিষয়ক অনলাইন কোর্স, হেল্পলাইন স্থাপন, টেলিমেডিসিন সেবা, তথ্য-প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের জনগণের মাঝে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে দ্রুততা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সমন্বয় করা, ই-হেলথ সার্ভিস কো-অর্ডিনেশন ইউনিটসহ রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে ই-সেবা চালু করাসহ নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যা ইতিমধ্যে প্রশংসনীয় হয়েছে। করোনা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলে বাণিজ্যিক কার্যক্রম প্রসারে শিগগিরই একটি ভার্চুয়াল ইউনিভার্সিটি অব মাল্টিমিডিয়া অ্যান্ড ইনোভেশন চালু করা হচ্ছে। একই সঙ্গে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে ই-কমার্সে ৫ লাখ এবং সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যারে আরও ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক তাঁর কর্মমুখর তৎপরতার কথা এভাবেই তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই ডিজিটাল বাংলাদেশ আজকে বাস্তবে রূপ পেয়েছে। গত ১১ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ও প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের সুপরামর্শে দেশ ডিজিলাইজড হয়েছে বলেই তৃণমূল পর্যায়ে সেবা দিতে সক্ষমতা অর্জন করেছি। আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক আরও বলেন, বিশ্বের সঙ্গে আমাদের দেশেও যখন করোনার আঘাত লাগে তখন সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসেন। এর মধ্যে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ও এমডি সায়েম সোবহান আনভীর সাহেব করোনা হাসপাতাল করার জন্য যখন বসুন্ধরা কনভেনশন সিটি দেওয়ার ঘোষণা দিলেন, তখন আমরাও অনুপ্রাণিত হলাম। আমরা যশোরে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার পার্কের প্রায় ৮০-৯০টি রুম আছে এমন একটি ডরমেটরি করোনা রোগীর চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য দিয়ে দিলাম। তিনি বলেন, করোনার শুরু থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সব মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে সশস্ত্র বাহিনী, চিকিৎসক, গণমাধ্যমকর্মীরা ফ্রন্টলাইনে থেকে কাজ করছেন। এই ফ্রন্টলাইনের যোদ্ধাদের জাতি সারাজীবন মনে রাখবে। আইসিটি মন্ত্রণালয়ের কিছু উদ্যোগ তুলে ধরে জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, করোনা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলে বাণিজ্যিক কার্যক্রম প্রসারে শিগগিরই একটি ভার্চুয়াল ইউনিভার্সিটি অব মাল্টিমিডিয়া অ্যান্ড ইনোভেশন চালু করা হচ্ছে। একই সঙ্গে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে ই-কমার্সে ৫ লাখ এবং সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যারে আরও ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। আমরা চাই, এখন যেসব তরুণ-তরুণী ঘরে বসে আছেন তারা যেন বেকার সময় না কাটান। প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে উঠুক। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনা ও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের সুপরামর্শে করোনা মোকাবিলায় জনগণকে সচেতন করতে বিশেষ করে বিজনেস কন্টিনিউটি প্ল্যান প্রণয়নসহ জনগণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় জরুরি সেবাসমূহ সহজতর করতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্ম চালুসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে। এতে মানুষ উপকৃতও হচ্ছে। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় স্থানীয়ভাবে ভেন্টিলেটর (কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার যন্ত্র) উৎপাদন শুরু করেছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের খ্যাতনামা মেডিকেল ইকুইপমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মেডট্রনিক তাদের পিবি-৫৬০ ভেন্টিলেটরটি তৈরি করার জন্য পেটেন্ট, সোর্স কোড, ডিজাইন, হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার দিয়ে বাংলাদেশের আগ্রহী প্রতিষ্ঠানসমূহকে প্রযুক্তিগত সহায়তা করছে। এখন এটি দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। আইসিটি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই নাগরিকদের জন্য করোনাভাইরাস সংক্রান্ত যে কোনো প্রয়োজনীয় পরামর্শ, করোনা সম্পর্কিত সব সেবার হালনাগাদ তথ্যের জন্য করোনা পোর্টাল (www.corona.gov.bd) চালু করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত নাগরিকরা ১ কোটি বার তথ্যের জন্য এই পোর্টালে ভিজিট করেছেন। করোনা বিষয়ক তথ্য সেবা, টেলিমেডিসিন সেবা, সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য জরুরি খাদ্য সহায়তা, সেলফ করোনা টেস্টিংসহ অনেকগুলো নতুন সেবা যুক্ত হয়েছে হেল্পলাইন ৩৩৩ নম্বরে। কল ফর ন্যাশন ডটকম : callfornation.com এই প্লাটফর্মে মূলত ব্যবসা, স্বাস্থ্য ও বিনোদন এবং লজিস্টিক সংক্রান্ত বিভিন্ন সেবা ও সমস্যার সমাধান নিয়ে যুক্ত হতে পারবেন উদ্যোক্তারা। কলফর ন্যাশন ডটকম (https://callfornation.com/) এ ছাড়া প্রবাসী হেল্পলাইন এবং স্টার্টআপ ডট গভ ডট বিডি (https://www.startupbangladesh.gov.bd/) প্লাটফর্মগুলো চালু করা হয়েছে। গুগুল ম্যাপ ও ওপেন স্ট্রিট ম্যাপসহ গ্রামীণফোনের নিজস্ব ম্যাপিং সিস্টেমে সংযুক্ত করা যাবে স্কুল, বাড়ি, হাসপাতাল ও ফার্মেসিসহ যে কোনো প্রয়োজনীয় স্থানের তথ্য। পাশাপাশি যে কেউ যে কোনো স্থান থেকে bangladeshchallenge.com ঠিকানায় গিয়ে সঠিক ম্যাপিং লোকেশন নিবন্ধন করতে পারবে। বিনামূল্যে সেবা নেওয়ার লিংকটি হচ্ছে https://web.facebook.com/amarlab.bd/। দেশে করোনোভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে ‘ন্যাশনাল ডেটা অ্যানালিটিক্স টাস্ক ফোর্স’ গঠন করা হয়েছে। করোনাভাইরাসের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে বাংলা ভাষায় গ্রাফচিত্রসহ মানচিত্রভিত্তিক কভিড-১৯ ট্র্যাকার তৈরি করেছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ। কভিড -১৯ ট্র্যাকার এই ভাইরাস আক্রমণের সার্বিক তথ্যচিত্র জানতে https://livecoronatest.com/।
প্রায় ৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবক ডাক্তার ‘ভলান্টিয়ার ডক্টরস পুল বিডি’ ব্যবহার করে ৩৩৩ কল সেন্টারের মাধ্যমে করোনা বিষয়ে নাগরিকগণকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে। সম্ভাব্য করোনা আক্রান্তের তথ্য ও ঝুঁকি যাচাইকরণে তৈরিকৃত ‘করোনা বিডি’ অ্যাপ ইতিমধ্যে ১ লাখেরও বেশি নাগরিক ডাউনলোড করেছেন এবং এর মাধ্যমে সেবা নিয়েছেন। করোনা আক্রান্ত রোগী এবং তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিতকরণে সহায়ক অ্যাপ হিসেবে ‘কন্টাক্ট ট্র্যাসিং’ অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে। করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী সুস্থ হওয়ার পর তার প্লাজমা সংগ্রহ এবং অসুস্থ রোগীর চিকিৎসায় এই প্লাজমা বিতরণের লক্ষ্যে ‘সহযোদ্ধা’ https://play.google.com/store/apps/details?id=bd.etl.livebloodbank নামক একটি প্লাজমা ডোনেশন নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছে। এটুআই-এর ই-লার্নিং প্লাটফর্ম ‘মুক্তপাঠে’ করোনা বিষয়ক ৮টি ই-লার্নিং কোর্স যুক্ত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রায় ৪ লাখ প্রশিক্ষণার্থী অনলাইন কোর্সে অংশ নিয়েছেন এবং প্রায় ২৬ হাজারেরও বেশি ডাক্তার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
করোনার প্রভাব-সংক্রান্ত গবেষণা : এটুআই-এর উদ্যোগে ১৬টি সেক্টর/খাতের চাকরির ক্ষেত্রে কভিড ১৯-এর প্রভাব-সংক্রান্ত একটি গবেষণা পরিচালনা করা হয়েছে। এ গবেষণার উদ্দেশ্য হলো- ইতিমধ্যে ও ভবিষ্যতে চাকরিচ্যুতির খাত চিহ্নিত করা এবং করোনা পরবর্তী চাকরির বাজার ও পেশার ধরন নির্ধারণ বিষয়ে ধারণা অর্জন করা। উল্লেখ্য, সরকারের ২৮টি মন্ত্রণালয়/বিভাগ দক্ষতা উন্নয়নের কাজে সম্পৃক্ত। কভিড-১৯-এর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এসব মন্ত্রণালয়/বিভাগের নতুন কর্মসংস্থানের চাহিদা অনুযায়ী বাজারমুখী দক্ষতা উন্নয়নমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন।
জানা যায়, এগ্রো-ফুড, হেলথকেয়ার সার্ভিসেস, আইসিটি ও ই- কমার্স, ফার্মাসিউটিক্যালস, ক্রিয়েটিভ মিডিয়া ইত্যাদি সেক্টরে ২৯ লাখেরও বেশি নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি হবে। ‘ফুড ফর নেশন’ কৃষিপণ্যের ডিজিটাল ওপেন প্লাটফর্ম কৃষিপণ্যের উৎপাদনকারী, পরিবেশক ও ক্রেতা-বিক্রেতাসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করবে। দেশে বর্তমানে ১ লাখ ১৫ হাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী/মুদিখানা এবং ১২ হাজার ফার্মেসির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। নিরাপদে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য ১২ হাজার স্বেচ্ছাসেবী সংযুক্ত আছে। গুগল প্লে স্টোর থেকে ‘করোনা ট্রেসার বিডি’ অ্যাপটি ডাউনলোড করা যাবে অথবা সরাসরি স্মার্টফোন থেকে (https://play.google.com/store/apps/detailsid=com.shohoz.tracer) লিংকে ক্লিক করেও অ্যাপটি ডাউনলোড করা যাবে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ভবিষ্যতের চাহিদা পূরণে সরকার ফ্রন্টিয়ার (অত্যাধুনিক) প্রযুক্তিতে দক্ষ মানুষ তৈরি করছে। তিনি বলেন, ঈদের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫০ লাখ পরিবারকে নগদ টাকা সহায়তা দিয়েছেন। এখানে আমরা একটা অ্যাপের মাধ্যমে তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করে টাকা দিয়েছি। যাতে সঠিক লোক টাকা পায়। এর আগে আমরা দেখলাম একজন ভিক্ষুক প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে তার সারাজীবনের জমানো ১০ হাজার টাকা জমা দিলেন। একইভাবেই প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল কিংবা বিদেশে বসবাসরত যে কেউ প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল কিংবা অন্য কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠানে যেন সহজেই টাকা দিতে পারে সেজন্য আমরা একটি অ্যাপ তৈরি করেছি। তা দিয়ে যে কেউ দেশ-বিদেশ থেকে টাকা পাঠাতে পারবে। https://ekdesh.ekpay.gov.bd/#/home অ্যাপটি ব্যবহার করে যে কেউ প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল কিংবা দেশের দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে টাকা দিতে পারবেন।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন