রাজশাহীর মসজিদ মিশন একাডেমি নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আড়ালে জামায়াতে ইসলামীর কর্মকান্ড চলছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এই প্রতিষ্ঠানে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) অনুমোদন ছাড়াই শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয় জামায়াত নির্ধারিত বই। স্কুলের ভিতরেই বসে জামায়াত নেতাদের গোপন বৈঠক। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটির এই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে মসজিদ মিশন একাডেমির বিভিন্ন দায়িত্ব থেকে জামায়াত-শিবিরের সক্রিয়দের সরিয়ে দেওয়া, আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া, আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষা সম্পাদন করা ও মসজিদ মিশন ফাউন্ডেশনের কার্যক্রমের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের একটি নিরীক্ষা প্রতিবেদনের আলোকে স্থানীয় এমপি ও শিক্ষামন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা সংবাদ সম্মেলন করে জানান, গত ১০ বছরে প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ১১ কোটি টাকার কোনো হদিস নেই। এই অর্থ রাজশাহীতে জামায়াতের সন্ত্রাসী তৎপরতার পেছনে ব্যয় করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন বাদশা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জামায়াতের একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান মসজিদ মিশন একাডেমি। এ থেকে আয়কৃত অর্থ জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্দেশনায় নিয়ন্ত্রিত হয়। সেখানে আরও উল্লেখ করা হয়, প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ মসজিদ মিশন ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি বোর্ড থেকে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং সব শিক্ষক ও কর্মচারীকে স্থানীয় জামায়াত-শিবির থেকে নিয়োগ করা হয়। স্বরাষ্ট্র ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাজশাহী মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র সাহেববাজার বড়কুঠি এলাকায় এই স্কুলটি বাংলাদেশ মসজিদ মিশন নামে একটি সংস্থার জেলা শাখার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত। মসজিদ মিশন ১৯৭৬ সালে সমাজসেবা অধিদফতর থেকে নিবন্ধিত হয়। এরপর ১৯৮২ সালে মসজিদ মিশন একাডেমি প্রতিষ্ঠা করে। নগরীতে একে একে তাদের মোট তিনটি শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়। অথচ মসজিদ মিশন সংস্থার গঠনতন্ত্রে কোনো স্কুল প্রতিষ্ঠার কথা ছিল না। আবার নিবন্ধন নেওয়ার পর থেকে মসজিদ মিশন তাদের বার্ষিক অডিট কিংবা কমিটি গঠনের জন্য সমাজসেবা অধিদফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। মসজিদ মিশন সংস্থা এবং তাদের একাডেমি পুরোপুরি জামায়াত নেতাদের ইচ্ছেমতো চলে আসছে। সরকারি একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে ২০১৬ সালেই মসজিদ মিশন একাডেমি ঘিরে জামায়াত নেতাদের কার্যক্রম পরিচালনার কথা উঠে আসে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মসজিদ মিশন একাডেমিতে যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তারা প্রত্যেকে জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকদের প্রায় প্রত্যেকেই জামায়াতের বিভিন্ন পদ-পদবিতে আছেন। তাদের বিরুদ্ধে মামলাও আছে। এমনকি প্রতিষ্ঠানে ওই নেতাদের বৈঠকও হয়।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা অত্যন্ত গোপনে দোয়া মাহফিল, গায়েবানা জানাজা, হরতালসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। একাডেমির শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম, শাহাদাৎ হুসাইন, আমিনুল ইসলাম ও মাইনুল ইসলামসহ অন্যরা জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার দিন হেতেম খাঁ গোরস্তান মসজিদে গায়েবানা জানাজা পড়েন। এরপর সরকারবিরোধী স্লোগান দিয়ে তারা পুলিশের ওপর হামলার চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে মসজিদ মিশন একাডেমির বড়কুঠি শাখায় নাশকতার পরিকল্পনা করতে গোপন বৈঠকে বসলে প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন শিক্ষকসহ আটজনকে গ্রেফতার করা হয়।

মসজিদ মিশন একাডেমি বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে এমপিওভুক্ত হয়। তবে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মসজিদ মিশন একাডেমি জামায়াতের একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান থেকে আয়কৃত অর্থ জামায়াতের কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির সব শিক্ষক-কর্মচারী জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী। প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়, প্রতিষ্ঠানটির জামায়াত-শিবির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে।
এরপর ২০১৬ সালের ২৩ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক অধিশাখা-২ থেকে শিক্ষা সচিবকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। এ চিঠিতে বলা হয়, মসজিদ মিশন সংস্থা একটি জামায়াতের প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশব্যাপী পরিচালিত হয়ে আসছে। এই সংস্থা পরিচালিত একাডেমিতে সরকারি শিক্ষা কারিকুলাম ছাড়াও শ্রেণিভিত্তিক ১০০ থেকে ৩০০ নম্বরের আরবি সিলেবাস পড়ানো হয়। এসব সিলেবাস বা বই নির্ধারণ করে দেয় জামায়াত। চিঠিতে গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া ওই গোপনীয় প্রতিবেদনের সুপারিশের আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য শিক্ষা সচিবকে নির্দেশনা দেওয়া হয়।

এরপর ওই বছরের ১০ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যানকে একটি চিঠি দিয়ে তিন কার্যদিবসের মধ্যে মসজিদ মিশন একাডেমি সম্পর্কে বিশেষ প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ প্রতিবেদন প্রস্তুতের জন্য ২২ নভেম্বর শিক্ষবোর্ডের তৎকালীন সচিব ও দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ড. মো. আনারুল হক প্রামাণিক তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেন। এই কমিটিকে দুই দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলা হয়।

কমিটি নির্ধারিত সময়েই তাদের প্রতিবেদন দাখিল করে। এতে বলা হয়, তদন্তকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনটির বিষয়বস্তুর সঙ্গে মসজিদ মিশন একাডেমির কার্যক্রমের মিল আছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকা সাতজন শিক্ষকের বিষয়ে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা থাকার বিষয়টি অধ্যক্ষ শিক্ষাবোর্ডের তদন্ত কমিটির কাছে স্বীকার করেছেন। অধ্যক্ষ এটাও স্বীকার করেন যে, তিনিসহ প্রতিষ্ঠানের অন্য সব শিক্ষক-কর্মচারী জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।

এনসিটিবির নির্ধারিত বইয়ের বাইরে বই পড়ানো বিষয়টিও অধ্যক্ষ তদন্ত কমিটির কাছে স্বীকার করেছেন। আর প্রতিষ্ঠানটির আয়-ব্যয়ের বিষয়ে অধ্যক্ষ তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছেন, যাবতীয় আয় ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে আসে। তিনি দাবি করেছেন, এসব অর্থ প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন এবং শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতায় ব্যয় হয়। স্থানীয় এলাকাবাসী এবং অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষাবোর্ডের তদন্ত কমিটি জানতে পারে, প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির সভাপতিসহ সব সদস্যই জামায়াতের রাজনীতি করেন। এই প্রতিবেদনটিও শিক্ষাবোর্ড থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে এরপর এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও উন্নয়ন) মো. মনিরুজ্জামানের সঙ্গে রবিবার দুপুরে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি সম্পর্কে এখন কিছু মনে নেই। আমি নোট রাখলাম। কাগজপত্র দেখে কথা বলতে পারব।’ সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন