ইবি প্রতিনিধি: যখন ভরদুপুরে কিরণ ছড়ানো তীর্যদীপ্ত সূর্য হেলান দিচ্ছে পশ্চিম আকাশে। তখনই দলবেঁধে বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়ামোড়ে ভীড় জমাতে শুরু করে সারাদিন সিয়াম পালন করে তৃষ্ণার্ত, ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত ক্যাম্পাস পিপীলিকারা। কারো হাতে মুড়ি-ছোলা, কেওবা ভাজাপোড়া হাতে, আবার কেও ট্যাং মিশ্রিত পানির শরবত নিয়ে আগাচ্ছে কেন্দ্রীয় ক্রিকেট খেলার মাঠে। রমজামে এই ক্রিকেট মাঠ যেনো সম্প্রতির প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।ধর্মীয় বিভেদ ভুলে গিয়ে মুসলিমদের সাথে অমুসলিমরাও যোগ দিচ্ছে সমান তালে। এ যেনো ভাতৃত্বের এক অপরূপ মেলবন্ধন।
ইফতার সামগ্রী নিয়ে কোথাও ৫ জন, কোথাও ১০ জন, কোথাও ২০ জন বা আবার কোথাও কোনো সামাজিক সংগঠনের শতাধিক সদস্যদের গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বসে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। গোলাকার, বৃত্তাকার বা সরলরেখা তৈরির মাধ্যমে সামনে মাখানো মুড়ি, খেজুর,পানি নিয়ে অপেক্ষায় মাগরিবের আজান শোনার। এমন দৃশ্য যেনো রমজান মাসে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়(ইবি) ক্যাম্পাসে অনুমেয় গত তিন বছর ধরে। প্রতিদিন প্রায় তিন শতাধিক শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের খোলা মাঠে বসে এই ইফতারে অংশ নেয়। ইফতার শেষে মাঠেই জামায়েতের সাথে কাতার বদ্ধ হয়ে মাগরিবের নামায আদায় এক অন্যরকম সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে খোলা মাঠে।
রমজান মাসের শুরু থেকেই শর্তসাপেক্ষে পরীক্ষা গ্রহণের সুযোগ রেখে একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এতে অনেক শিক্ষার্থীই দুশ্চিন্তায় পরে যায় এবার আদৌ সবাই মিলে ইফতার গ্রহণের সুযোগ পাওয়া যাবে কিনা! কিন্তু বছরের শ্রেষ্ঠ এই মাসে কোনো ছুটিই বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। সম্প্রীতির এই বন্ধনে শুধু মুসলিম শিক্ষার্থীরাই নয় সবধর্মের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিলো। যার কারণেই ইসলাম ধর্মকে বলা হয় শ্রেষ্ঠ ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার ধর্ম। অন্যদিকে একাধিক ক্যাম্পাসে যখন ইফতারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে তখন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের এরুপ মনোমুগ্ধকর দৃশ্য চোখে আঙ্গুল দিয়ে জবাব দেয় তাদের যারা এর বিরোধী।
ইফতার শুরুর পূর্বে কথা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের রিমনের সাথে। সে জানায়, তার চতুর্থ বর্ষের সেমিস্টার ফাইনাল চলমান থাকায় বাড়ি যাওয়া হচ্ছে না এই ছুটিতে। পরিবারের সাথে ইফতার করতে পারবোনা ভেবে মন খারাপ ছিলো। তবে গত দুইদিন শতাধিক বন্ধু, সিনিয়র, জুনিয়র মিলে একসাথে ইফতার করেছি। আমি সত্যি আমার পরিবারকে মিস করিনি। মনে হচ্ছিলো যেনো বাসায়ই নিজের পরিবারের সাথেই আছি।
ইফতারের সময় কথা হয় সুদূর খাগড়াছড়ি থেকে আসা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর মং ক্যাচিং মার্মার সাথে। সে বলে, এই খোলা মাঠে ইফতারের যে আয়োজন হয় তা সত্যি ই ভালো একটি উদ্যোগ। এতে সাম্প্রদায়িকতা ভুলে গিয়ে একটা সম্প্রতির পরিবেশ তৈরি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সাথে একত্রে বসে ইফতারে অংশ নিতে পারায় নিজের কাছেও খুব ভালো লাগছে। বন্ধুদের সাথে এসময় টা আমার সারাজীবনই মনে থাকবে। ইফতারকে ইউনেস্কোর বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেয়ার কারণ নিজ চোখেও দেখলাম। আমি মনে করি ক্যাম্পাসে বছরে একমাসই এমন সুযোগ থাকে। তাই আমি নিজেও উপভোগ করছি।
সদ্য মাস্টার্স শেষ করা মোয়াজ্জেম হোসাইন আদনান তার ক্যাম্পাস লাইফের শেষ সময়টা পার করছেন। গ্র্যাজুয়েশন শেষ হওয়ার পরও শেষ সময়টা স্মরণীয় করে রাখতে তিনি রমজানের শেষ দিকে বাড়ি যাবেন বলে জানান। তিনি আরো বলেন, এই শেষ সময়ে ক্যাম্পাসকে খুব বেশী মিস করছি। দীর্ঘ ৬ বছর পার করার পর এই ক্যাম্পাস ছেড়ে যেতে আমার সত্যি ই খুব খারাপ লাগছে। তবে সারাদিন রোজা রেখে যখন সবাই একসাথে বসে খোলা মাঠে এই ইফতারে বসি তখন মনে হয় ক্যাম্পাস জীবনটা আরেকটু দীর্ঘ হলেও পারতো।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রায় ২০ টিরও অধিক স্বেচ্ছাসেবী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে। বিভিন্ন সময় তারা নিজেদের মতো ইফতারের আয়োজন করে। তারা নিজেরা ইফতার করার পাশাপাশি নিজেরা চাঁদা দিয়ে দুস্থ মানুষের জন্য ইফতারের ব্যবস্থা করে থাকে। ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সম্প্রতির এই আয়োজন সত্যি ই চোখ শীতল করে দিতে যথেষ্ট।