সবুজ পাহাড়ে প্রকৃতির কোলে দাঁড়িয়ে আছে ময়নামতী ওয়্যার সিমেট্রি। প্রথমেই চোখে পড়বে সবুজ ঘাসের গালিচায় হরেক রঙের ফুল। গাছ-গাছালি ঘিরে সুনসান নীরবতা। এখানে শায়িত আছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈনিকরা। কুমিল্লা জেলায় অবস্থিত কমনওয়েলথ যুদ্ধ সমাধিক্ষেত্র। ১৯৪১-৪৫ সালে বার্মায় (বর্তমান মিয়ানমার) সংঘটিত যুদ্ধে যে ৪৫ হাজার সৈনিক নিহত হন তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে বার্মা, আসাম এবং বাংলাদেশে মোট নয়টি রণ সমাধিক্ষেত্র তৈরি করা হয়। বাংলাদেশে দুটি কমনওয়েলথ রণ সমাধিক্ষেত্র আছে। যার অন্যটি চট্টগ্রাম শহরে অবস্থিত। প্রতি বছর দেশ-বিদেশের বহু দর্শনার্থী যুদ্ধে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসব রণ সমাধিক্ষেত্রে আসেন।

জানা যায়, ময়নামতী রণ সমাধিক্ষেত্র মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-১৯৪৫) নিহত ভারতীয় ও ব্রিটিশ সৈন্যদের কবরস্থান। এটি ১৯৪৩-১৯৪৪ সালে তৈরি করা হয়। কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের খুব কাছে এ সমাধিক্ষেত্রের অবস্থান। সমাধিক্ষেত্রটি প্রতিষ্ঠা করেছে কমনওয়েলথ ওয়্যার গ্রেভস কমিশন। প্রতি বছর নভেম্বর মাসে সব ধর্মের ধর্মগুরুদের সমন্বয়ে এখানে বার্ষিক প্রার্থনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন ময়নামতী একটি ছোট গ্রাম হলেও সেনাবাহিনীর একটি বড় ঘাঁটিতে পরিণত হয়। এখানে বড় একটি হাসপাতালও স্থাপন করা হয়। এ ছাড়াও কুমিল্লা ছিল যুদ্ধ-সরঞ্জাম সরবরাহের ক্ষেত্র। বিমান ঘাঁটি এবং ১৯৪৪ সালে ইম্ফলে স্থানান্তরিত হওয়ার আগে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর চতুর্দশ সদর দফতর ছিল এখানে।

এ সমাধিক্ষেত্রে মোট ৭৩৬টি কবর আছে। যুদ্ধের পর বিভিন্ন স্থান থেকে কিছু মরদেহ স্থানান্তর করে সমাহিত করা হয়। বাহিনী অনুযায়ী এখানে মোট তিনজন নাবিক, ৫৬৭ জন সৈনিক এবং ১৬৬ জন বৈমানিক সমাহিত আছেন। সর্বমোট ৭২৩ জন নিহতের পরিচয় জানা সম্ভব হয়েছিল। সমাধিক্ষেত্রটির প্রবেশমুখে একটি তোরণ ঘর আছে। যার ভিতরের দেয়ালে সমাধিক্ষেত্রের ইতিহাস ও বিবরণ ইংরেজি-বাংলায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। তোরণ ঘর থেকে সামনে প্রশস্ত পথ। যার দুই পাশে সারি সারি এপিটাফ আর তাতে নিহতের নাম, পরিচয়, মৃত্যু তারিখ লেখা। এপিটাফে নিহত সৈন্যদের ধর্ম অনুযায়ী ধর্মীয় প্রতীক লক্ষ্য করা যায়। খ্রিস্টানদের এপিটাফে ক্রুশ আর মুসলমানদের এপিটাফে আরবি লেখা। এই প্রশস্ত পথ ধরে সামনে রয়েছে সিঁড়ি দেওয়া বেদি। বেদির ওপরে খ্রিস্টধর্মীয় প্রতীক ক্রুশ। বেদির দুই পাশে আরও দুটি তোরণ ঘর। এ দুটি তোরণ ঘর দিয়ে সমাধিক্ষেত্রের পেছনের অংশে যাওয়া যায়। দুই কবরের মাঝে রয়েছে একটি করে ফুলগাছ। তাছাড়া পুরো সমাধিক্ষেত্রজুড়ে রয়েছে অনেক গাছ। সমাধিক্ষেত্রের সামনের অংশের প্রশস্ত পথের পাশেই ব্যতিক্রমী একটি কবর রয়েছে যেখানে একসঙ্গে ২৩টি এপিটাফ দিয়ে এক স্থানকে ঘিরে রাখা হয়েছে। স্থানটি ছিল মূলত ২৩ জন বিমান সৈনিকের একটি গণকবর। সমাধিক্ষেত্র দেখতে আসা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নওশাদ হোসাইন জানান, এমন ঐতিহাসিক জায়গা দেশে খুব কমই আছে। এখানে এসে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। বিশ্বযুদ্ধের বিষয়ে কিছু জ্ঞান অর্জন করেছি। সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন