ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে প্রাণভয়ে ভারতে পালিয়ে যান স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। স্বৈরাচার পতনের পর দেশের দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নতুন সরকার গঠনের পর থেকে বড় ধরনের চাপের মুখে পড়েছে রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি। রাজনীতিতে জাপা কি টিকে থাকবে, নাকি হারিয়ে যাবে এমন প্রশ্ন উঠেছে।
‘ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-জনতা’ আওয়ামী লীগের সব অপকর্মের দোসর হিসেবে জাতীয় পার্টিকে দোষারোপ করেছে। এরফলে গত ৩১ অক্টোবর রাজধানীর বিজয়নগরে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এর প্রতিবাদে শনিবার (২ নভেম্বর) বিক্ষোভ সমাবেশ ডেকেছিল জাতীয় পার্টি। পরে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র শ্রমিক জনতা’। দুইপক্ষের উত্তেজনার পর, পিছুহটে জাতীয় পার্টি, প্রত্যাহার করের নেয় কর্মসূচি। কিন্তু তাদের খুলনা বিভাগ কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ঢাকার জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়েছে বলে দাবি করেছেন দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তিনি বলেছেন, আমরা যতটুকু জানি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে তারা রাজু ভাস্কর্য থেকে ছাত্র অধিকার পরিষদের বিন ইয়ামিনের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ভাঙচুর চালান।
জাতীয় পার্টির অফিসে হামলার ঘটনাটি ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মিলিত কোনো সিদ্ধান্ত নয়’ বলে জানিয়েছেন প্ল্যাটফর্মটির মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। মুখপাত্র বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চায় দেশের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসুক এবং সরকার সেটা নিশ্চিত করুক।
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদে রংপুরে লাঠি মিছিল ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে দলটির নেতাকর্মীরা। সমাবেশ থেকে হামলার ইন্ধনদাতা গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরসহ কয়েকজন ছাত্রের নোংরা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ জানানো হয়।
খুলনায় জাতীয় পার্টির (জাপা) কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দিয়েছে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। শনিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে নগরীর ডাকবাংলা মোড়ে অবস্থিত জাপার মহানগর ও জেলা কার্যালয়ে এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয়রা বলেছেন, শনিবার বিকেলে নগরীর শিববাড়ী মোড়ে সমাবেশ করে ছাত্র-জনতা। এরপর সন্ধ্যা ৬টার দিকে তারা মিছিল নিয়ে শহিদ হাদিস পার্কের দিকে যাওয়ার পথে ডাকবাংলো মোড়ে জাপা কার্যালয়ের সামনে এসে তারা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। মিছিল থেকে কয়েকজন জাপা কার্যালয়ের সাইনবোর্ড ভেঙে ফেলে।
পরবর্তী সময়ে তারা কার্যালয়ের ভেতর প্রবেশ করে চেয়ার এবং টেবিলসহ বিভিন্ন আসবাব ভাঙচুর করে। কার্যালয় থেকে বিভিন্ন জিনিসপত্র বাইরে এনে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে তারা জাপার বিভিন্ন নেতার বিরুদ্ধে নানা ধরনের স্লোগান দিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
জাতীয় পার্টি ঘিরে এই পরিস্থিতিতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমরা মনে করি, এর মধ্য দিয়ে পরিকল্পিতভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা চলছে অযথা এবং অপ্রয়োজনীয়ভাবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার আমরা কারা? জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি গণমাধ্যমকে বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব বা ছাত্রদের নাম যুক্ত হওয়া কোনোভাবেই সমীচীন নয়। ফ্যাসিবাদী এবং তাদের সহযোগীদের রাজনৈতিকভাবেই আমাদের মোকাবিলা করতে হবে।
শনিবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলম তাদের ফেসবুকে অভিন্ন পোস্ট দেন। তারা লিখেছেন, ‘যেই পথে গেছে আপা, সেই পথে যাবে জাপা।’ অর্থাৎ শেখ হাসিনা যে পথে গেছেন, জাতীয় পার্টিও সে পথে যাবে। তাদের এই অবস্থান জাতীয় পার্টিকে রাজনীতি থেকে মূলোৎপাটনের চেষ্টা হিসেবে দেখছেন দলটির নেতারা।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন,গত ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর শুরুতে সেনাবাহিনী ও পরে অন্তর্বর্তী সরকারের সংলাপে ডাক পাওয়া জাপার জন্য গুডলাক ছিল। কিন্তু দলটির নেতাদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবে তারা রাজনীতি থেকে ছিটকে যান। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চাপে সর্বশেষ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে প্রধান উপদেষ্টা জাপাকে ডাকেননি। জবাবে দলটি দুই সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহকে রংপুরে অবাঞ্চিত করে। জাপার এ ধরনের সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী ছিল। জাপার এখন কোনোভাবেই দ্বন্ধে জড়ানো উচিত হবে না। এই পরিস্থিতিতে দলটির উচিৎ সরকার ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক তৈরির পথ খুঁজে বের করা। রংপুরে জুলাই আগস্টের গণআন্দোলনে জাপার যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল সেটা কাজে লাগাতে হবে। না হলে জাপা চলমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাতে পারবে না।
২০০৮ সালে ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে ক্রমেই ঘনিষ্ঠতা বাড়ে জাপার। এ সময় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বাড়তে থাকে দূরত্ব।