- Bangladesher Shomoy | বাংলাদেশের সময়.কম - https://www.bangladeshershomoy.com -

মহামারী আসার কারণ, করনীয় এবং বাচার উপায়!

মহামারী মূলত আরবী “ওয়াবা” শব্দ থেকে এসেছে যা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে এমন মহামারীকে বুঝায়। মহামারীর ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে Epidemic বা pestilence.পৃথিবীতে মানবজাতির বসবাসের সূচনালগ্ন থেকে যুগে যুগে বিভিন্ন সময় মানবজাতির উপর বিভিন্ন রোগ, বিপদ-আপদ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল।

ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০ এ। গ্রিসের ফুসফুস নামে খ্যাত এথেন্সে বসন্ত রোগ প্রায় ৩০ হাজার লোক মারা যায়।
রোমে ১৬৫ থেকে ১৮০ খ্রিস্টব্দ পর্যন্ত গুটি বসন্তে জনমানব শূন্য হয়ে যায়। ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ১৮ হিজরীতে মোতাবেক ৬৩৯ সালে ফিলিস্তিন আমওয়াস নগরীতে প্লেগ মহামারীতে প্রায় ২৫ হাজার লোক মারা যায়।

৬৯ হিজরীতে বসরা নগরীতে জারিফ মহামারীতে লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়। ৮৭ হিজরীতে ইরাক ও সিরিয়াতে ফাতায়াত মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। এতে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগন বেশি মারা যায় তাই এটিকে তাউন আশরাফ বা সম্ভ্রান্ত মহামারী বলে।

১৩১ হিজরীতে ছড়িয়ে পড়ে তাউনু মুসলিম ইবনু কুতাইবা। মুসলিম জাহানের বিখ্যাত সেনাপতি কুতাইবা এই মহামারীতে মারা যান।
৪৪৯ হিজরীতে মধ্য এশিয়াতে এক মহামারীতে প্রায় ২ মিলিয়ন লোক মারা যায়। ( তারিখুল ইসলাম) এছাড়া আব্বাসীয়, মামলুক এবং আইয়ুবী শাসনামলে ইসলামি প্রাচ্যে আরো কিছু মহামারী ছড়িয়ে পড়েছিল।

১৩৯২ সালে আলেপ্পোতে ” আল-ফানাউল আজিম” নামক মহামারীতে লক্ষাধিক মানুষের প্রাণ যায়। ১৬৩৩ সালে আমেরিকা ও ইউরোপে স্মলপক্স ছড়িয়ে পড়ে প্রায় ২ কোটি মানুষ মারা যায়। ১৮৬০ সালে প্লেগ মহামারীতে ১ কোটিরও বেশি মানুষ মারা যায়।
১৯১৮ সাল থেকে শুরু হওয়া ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীতে ১ কোটিরও বেশি মানুষ মারা যায়।

বর্তমানে “করোনা” ( Covid-19) নামক ভাইরাস মহামারী আকারে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। এখন পর্যন্ত ৫ লক্ষাধিক মানুষ মারা গিয়েছে। এর থেকে বাচার জন্য আমাদের মুক্তির পথ খুজতে হবে।

~মহামারী কেন আসে?

১. মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরানে বলেছেনঃ জলে ও স্থলে মানুষের কৃতকর্মের দরুন বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান। যাতে তারা ফিরে আসে। ( সুরা আর-রূম ৪১)

অন্যত্র আল্লাহ আরো বলেছেনঃ তোমাদের উপর যেসব বিপদ-আপদ পতিত হয়, তা তোমাদের কর্মের ফল এবং তিনি তোমাদের অনেক গুনাহ ক্ষমা করে দেন। ( সুরা আশ- শুরাঃ৩০)

২. হাদীস শরীফে এসেছে আব্দুল্লাহ বিন উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসুল (সঃ) বলেছেন, যখন কোন জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা পাপাচার ছড়িয়ে পড়ে তখন সেখানে মহামারী আকারে প্লেগরোগের প্রাদুর্ভাব হয়। তাছাড়া এমন সব ব্যাধির উদ্ভব হয়, যা পূর্বেকার লোকদের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি। (ইবনে মাজাহ-৪০১৯)

উল্লেখিত কুরান হাদীস দ্বারা সুস্পষ্ট প্রমানিত হয় যে, পৃথিবীতে যত মহামারী আসে তা মানুষের কর্মের ফল। যখন কোন জাতির মাঝে পাপাচার, যিনা-ব্যভিচার, অন্যায়-অত্যাচার এবং অপরাধ মুলক কর্ম-কান্ড সংঘটিত হতে থাকে তখন আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির উপর গযব হিসেবে বিভিন্ন রোগ, বিপদ-আপদ মহামারী আকারে ছড়িয়ে দিয়ে চরম শিক্ষা দিয়ে থাকেন যাতে মানুষ সঠিক পথে ফিরে আসে।

৩. এছাড়া অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন, কিয়ামতের আগে মানবজাতির উপর ছোট ছোট আযাব আস্বাদন করাবেন যাতে মানুষ আল্লাহর পথে ফিরে আসে। যেমনঃ গুরু শাস্তির পূর্বে আমি অবশ্যই তাদেরকে লঘু শাস্তি আস্বাদন করাব, যাতে তারা প্রত্যাবর্তন করে। (সুরা সাজদাহ-২১)

৪. মহামারী কাফির সম্প্রদায়ের জন্য এক গযব এবং মুমিন সম্প্রদায়ের জন্য এক পরীক্ষা। যেসব মুমিনরা এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারবে তাদের জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সুসংবাদ রয়েছে।

যেমন আল্লাহ বলেছেনঃ অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, খুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দেও সবরকারীদের। (সুরা বাকারা-১৫৫)

আর এই জাতীয় মহামারী ভাইরাস কাফির তথা আল্লাহ তায়ালার অস্বীকারকারী বান্দাদের জন্য এক চরম গযব শাস্তি, দুনিয়াতেও তারা শাস্তি আস্বাদন করবে পরকালেও তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তির অপেক্ষা। আর যেসব মুমিন ব্যক্তিরা এই মহামারী ভাইরাসে মারা যাবে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে শাহাদাতের মর্যাদা প্রদান করবেন। বুখারী

“করনীয় এবং বাচার উপায়”

আল্লাহ তায়ালার আদেশ-নিষেধ ও রাসুল ( সঃ) এর সুন্নাতকে পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করার পাশাপাশি তার শিখানো আমল ও দোয়ার মাধ্যমে আমরা যে কোনো মহামারী ভাইরাস থেকে মুক্তি পেতে পারি।

রাসুল (সঃ) বলেছেন, মহামারীর সময় আক্রান্ত এলাকায় অবস্থান করলে ঐ স্থান ত্যাগ করা যাবেনা এবং অন্য এলাকায় অবস্থান করলে আক্রান্ত এলাকায় প্রবেশ করা যাবেনা। (বুখারী)

রাসুল (সঃ) আরো বলেছেন, অসুস্থদেরকে সুস্থ মানুষ থেকে আলাদা করে রাখতে। (বুখারী)

বিশেষত আজ করোনা নামক ভাইরাস বিশ্বব্যাপী মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রমানিত যে হাচি-কাশি এবং একই পাত্রে খাবার খাওয়ার মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে যাচ্ছে।
রাসুল (সঃ) হাচি-কাশি দেওয়ার সময় হাতের তালু বা কাপড়-রুমাল ব্যবহার করার জন্য বলেছেন। (তিরমিজি-২৭৪৫)

তিনি, যে কোনো খাবার পাত্রে নিঃশ্বাস ফেলতে এবং ফু দিতে নিষেধ করেছেন। (ইবনে মাজাহ-৩৪২৯)

“বাচার উপায়”

১.বেশি বেশি কুরান তেলওয়াত করা কুরানের আমল করা। যে কোনো রোগের মহাঔষধ হচ্ছে আল-কুরান। কেননা রাসুল (সঃ) বলেছনেঃ উত্তম ঔষধ হচ্ছে আল্ল-কুরান। (ইবনে মাজাহ-৩৫৩৩)

২. সুরা ফাতেহা যে কোনো রোগের ঔষধ কেননা রাসুল (সঃ) এই সুরাটিকে সুরাতুস শিফা বা রোগ মুক্তির সুরা বলেছেন। (আল-হাদীস)

৩. নিয়মিত কালোজিরা এবং মধু সেবন করা। কেননা মৃত্যু ছাড়া সব রোগের ঔষধ হচ্ছে কালোজিরা।
(ইবনে মাজাহ-৩৪৪৭)

৪. বেশি করে দান সদকা করা। কেননা রাসুল (সঃ) বলেছেনঃ বেশি করে দান-সদকা করার মাধ্যমে বিপদ-আপদ দূরীভূত হয়ে যায়। (আল-হাদীস)

৫. বেশি করে শাক-সবজি ও ফল-ফলাদি খেতে হবে এবং শরীলের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।

৬. এছাড়া ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা সেবা নিতে হবে।

৭. সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি আমাদেরকে আরো সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে।

৮. দোয়া দরুদ বেশি করে পড়া।

পবিত্র কুরানে বর্ণিত বিপদ-আপদ এর দোয়া হচ্ছে :

১। ইন্নালিল্লাহি ও ইন্না’ইলাইহি রজিউন।

২। লা ইলা’হা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ্জ্বলিমিন।

হাদীসে বর্ণিত দোয়াঃ

১।আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল বারছি ওয়াল জুননি ওয়াল জুযামি ওমেন সায়্যিল আসক্বম।
অর্থঃ হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে আশ্রয় চায় শ্বেত রোগ, পাগলামি, কুষ্ঠ রোগ এবং জানা-অজানা সকল প্রকার দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে। (আবু দাউদ)

২ আল্লাহুমা ইন্নি আস-আলুকাল আফিয়াতা। অর্থঃ হে আল্লাহ, তোমার কাছে আমি নিরাপত্তা ও সুস্থতা কামনা করছি। (তিরমিজি)

৩। আল্লাহুমা ইন্নি আউজুবিকালিমাতিল্লাহি আত্ব-তা’ম্মাতে মিন গধবিহি ওশাররি ইবাদিহি ওমেন হামাযাতিশ শায়াত্বিনে ওয়ায়াই-ইহাধুরুন।

অর্থঃ আল্লাহর পূর্ণ কালেমাসমূহ দ্বারা তার গযব ও তার বান্দাদের খারাপী ও শয়তানের কুমন্ত্রণা ও আমার নিকট তার উপস্থিত হওয়া থেকে আশ্রয় চায়ছি। (আবু-দাউদ)

৪। আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিম-মুনকারাতিল আখলাকি ওয়াল আয়ামালি ওয়াল আহওয়ায়ি ওয়াল আদওয়ায়ি। অর্থঃ হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে নিকৃষ্ট চরিত্র, কাজ প্রবৃত্তি এবং নিকৃষ্ট ব্যাধিসমূহ থেকে আশ্রয় চায়।(তিরমিজি)

এছাড়া আমাদেরকে বেশি বেশি আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে দরুদ পাঠ করতে হবে এবং ইসলামের বিধিবিধান সঠিকভাবে মেনে চলতে হবে।

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সচেতন হওয়ার এবং ইসলাম নির্দেশিত পন্থানুযায়ী আমল করার তাওফিক দান করুন।
আমাদেরকে সকল প্রকার ক্ষতিকর ব্যাধি থেকে ও মহামারী থেকে নিরাপদ রাখুন।
এবং সুস্থভাবে জীবন যাপন করার তাওফিক দান করুন। আমিন

লেখক: আমির হামজা (সায়েম)