- Bangladesher Shomoy | বাংলাদেশের সময়.কম - https://www.bangladeshershomoy.com -

ফ্যাসিস্ট হাসিনার দানব হয়ে ওঠার সহযোগী-পর্ব ৭

মাহমুদুর রহমান: সর্বোপরি আগ্রাসী ভারত: দানব শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসন প্রায় ষোল বছর দীর্ঘায়িত করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে ভারত। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর উপর দিল্লির একচ্ছত্র প্রভুত্ব বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা নতুন কিছু নয়। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে ১৯০ বছর ব্যাপী বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হতেই ভারত এই অঞ্চলে প্রভুত্ব কায়েমের পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

১৯৪৯ সালে ভুটানের হাতে মোচড় দিয়ে আধিপত্যবাদী দেশটি যে একটি অন্তকালীন প্রভুত্বমূলক চুক্তি সম্পাদন করেছিল তার সঙ্গে হিমালয়ের ক্ষুদ্র রাজ্যটির ১৯১০ সালে সম্পাদিত বৃটিশ হেজেমনিক চুক্তির (পুনাখা চুক্তি) কোন চরিত্রগত পার্থক্য ছিল না। ফলে আজ পর্যন্ত ভুটানকে আধা স্বাধীন দেশের অমর্যাদা নিয়েই টিকে থাকতে হচ্ছে।

ভারতের অনিচ্ছার ফলে, জাতিসংঘের পাঁচ সদস্যের (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, এবং ফ্রান্স) মধ্যে কারো সঙ্গেই ভুটানের অদ্যাবধি আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে নাই। উপনিবেশ উত্তর (Post-Colonial) দক্ষিণ এশিয়ায়, সৃষ্টি থেকেই পাকিস্তান তার সামরিক ও অর্থনৈতিক দুর্বলতা সত্ত্বেও, ভারতের আঞ্চলিক প্রভুত্ব কায়েমের স্বপ্ন বাস্তবায়নে যথাসাধ্য বাধা দিয়ে এসেছে।

আফগানিস্তানের সাথে ভারতের কোন সীমান্ত না থাকার ফলে সেখানে ভারতের থাবা বিস্তারের প্রচেষ্টা কোন কালেই তেমন ফলপ্রসূ হয় নাই। কখনও রাশিয়া, আবার কখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লেজুড় হয়ে ভারতকে কাবুলে কাজ করতে হয়েছে। নেপাল, শ্রীলংকা এবং মালদ্বীপও ভারতীয় প্রভুত্বকে আজ পর্যন্ত মেনে নেয় নাই। দেশগুলির জনগণ ভারতীয় হেজেমনির বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে লড়াই করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের গল্প অবশ্য অনেকটাই ভিন্ন।

১৯৭১ সালে ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভুত্ব কায়েমের মোক্ষম সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্যই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান করেছিল। এর আগে ১৯৪৭ এবং ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ অমিমাংসিতভাবে শেষ হয়েছিল। কিন্তু, ১৯৭১ এ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ফলে শুধু যে, পাকিস্তান দ্বিখন্ডিত হয়ে হীনবল হয়ে পড়েছিল তাই নয়, ভারতের পূর্ব সীমান্তে সামরিক দিক দিয়ে দুর্বল এবং ভারতের প্রতি নির্ভরশীল ও অনুগত এক নতুন রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছিল।

দিল্লির নীতিনির্ধারকরা ধারনা করেছিল যে, ধর্মে মুসলমান হলেও, বাংলাদেশের জনগণ যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমান ধর্মাবলম্বী শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে হিন্দু ভারতের সহায়তা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, কাজেই মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও নব্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশটির অধিকাংশ জনগোষ্ঠী ইসলামের প্রতি বিমুখ হয়ে ক্রমেই জীবনাচারে হিন্দু সংস্কৃতি গ্রহণ করবে। অর্থাৎ, আশা ছিল যে, রাজনৈতিকভাবে ও ধর্মীয়ভাবে ভারতের সাথে একেবারে মিশে না গেলেও বাংলাদেশের জনগণ সোৎসাহে সাংস্কৃতিকভাবে হিন্দুত্ববাদের অধীনতা মেনে নেবে।

বাঙ্গালী মুসলমানের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং স্বতন্ত্রতা চিরতরে কবর দিতেই হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতি থেকে জন্ম নেয়া তথাকথিত বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ এবং মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য ভারতের প্রতি অনন্তকালের কৃতজ্ঞতার বয়ান তৈরী করে মগজ ধোলাইয়ের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। দিল্লির শাসকরা ধরেই নিয়েছিল যে, শেখ মুজিব সরকারের মাধ্যমে ভুটানের মতই অতি সহজে তারা বাংলাদেশের উপরও এক চিরস্থায়ী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। সেই লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের প্রারম্ভেই বাংলাদেশের সাথে পঁচিশ বছর মেয়াদী এক তথাকথিত “বন্ধুত্ব” চুক্তিও সম্পাদন করা হয়েছিল।

ভারতের আধিপত্যবাদী উদ্দেশ্য বুঝতে বাংলাদেশের জনগণের খুব বেশি সময় লাগে নাই। ভারতের এ দেশীয় এজেন্টদের পাকিস্তানের শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে যুদ্ধকে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রূপান্তরিত করবার অপকৌশল ব্যর্থ হয় এবং ১৯৭৫ সালে, স্বাধীনতা প্রাপ্তির মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই শেখ মুজিবর রহমানের স্বৈরাচারী, এক দলীয় বাকশাল সরকারের রক্তাক্ত পতন ঘটে। এরপর আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফিরতে ২১ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।

১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জেতার জন্য শেখ হাসিনাকে তার পিতার স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের জন্য ক্ষমা চাইতে হয়েছিল, একজন অতি ধার্মিক মুসলমানের মুখোশ পড়তে হয়েছিল, এবং তিনি যে ভারতীয় দালাল নন সেটি জনগণকে বারবার বোঝাতে হয়েছিল। এত কিছুর পরও শেখ হাসিনা তৎকালিন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় পাঁচ বছরের বেশি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেন নাই। ২০০১ সালের নির্বাচনে তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ধরাশায়ী হয়েছিল।

শেখ হাসিনার এক মেয়াদ (১৯৯৬-২০০১) পরেই বিএনপি ক্ষমতায় ফিরে এলে দিল্লির ডিপ স্টেইট বুঝতে পারল যে, গণতন্ত্র বজায় থাকলে বাংলাদেশের জনগণের উপর দীর্ঘ সময় ধরে প্রভুত্ব করা সম্ভব হবে না। ভারতীয় গোয়েন্দাদের শিকড় বাংলাদেশের সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে বিস্তার ঘটানোর জন্য হাসিনার নেতৃত্বে দিল্লির পুতুল সরকারের একটানা দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেই সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বিলুপ্তির ষড়যন্ত্র করা হয়।

সেই ষড়যন্ত্রে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপীল বিভাগের আরো তিন বিচারপতি (মোজাম্মেল হোসেন, এস কে সিনহা, এবং সৈয়দ মাহমুদ হোসেন) মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। সুপ্রীম কোর্টের রায়ে ৪-৩ ভোটে তত্ত্বাবধায়ক প্রথা বাতিল হয়ে গেলে ২০১৩ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কবর রচিত হয়ে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম হয়।

সেই সময় পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামোফোবিয়া প্রবল হয়ে উঠেছিল। ভারত এবং শেখ হাসিনা সেই ইসলামোফোবিয়ার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে। বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলমান ধর্মাবলম্বী হলেও কথিত ইসলামী জঙ্গী দমনের নামে ধার্মিক মুসলমান এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে অবর্ণনীয় নিপীড়ন শুরু করে হিন্দুত্ববাদী ভারতের পুতুল, শেখ হাসিনা সরকার। হাজার হাজার নাগরিককে গুম এবং বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়।

অসংখ্য মানুষকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। ভারতীয় এজেন্ডা প্রতিপালন করার জন্য একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে তামাশা করে একের পর এক ইসলামপন্থী রাজনৈতিক নেতাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। দিল্লির প্রশ্রয়ে দানব শেখ হাসিনা জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে দেশকে এক অলিখিত এক দলীয় রাষ্ট্র পরিণত করেন। বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ভারতের সাথে একের পর এক একতরফা চুক্তি সম্পাদন করা হয়।

শেখ হাসিনা নিজেই প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন যে, তিনি ভারতকে যা দিয়েছেন সেটা ভারত কোনদিন ভুলতে পারবে না। শেখ হাসিনা দেশের সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিয়ে যেভাবে ভারতের একতরফা স্বার্থ রক্ষা করেছেন তার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা নীচে দেয়া হলো:

১। বিনা শুল্কে অথবা নাম মাত্র শুল্কে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে ভারতকে করিডোর প্রদান
২। বাংলাদেশে ভারতীয় রাডার স্থাপনের অনুমতি প্রদান
৩। বাংলাদেশের বন্দর পরিচালনা এবং সেগুলির ব্যবহারে ভারতকে একচ্ছত্র অধিকার প্রদান
৪। সেনা বাহিনীসহ বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দিল্লির অধীনে সমর্পণ
৫। গঙ্গা ও তিস্তাসহ ৫৪ টি অভিন্ন নদীর উপর আন্তর্জাতিক আইনে ভাটির দেশ বাংলাদেশের অধিকার ভারতের কাছে বিসর্জন
৬। বাংলাদেশকে ভারতের বাজারে পরিণতকরণ
৭। বাংলাদেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর চাকুরীর বাজার সংকুচিত করে ভারতীয় নাগরিকদের এ দেশে চাকুরীর অবারিত সুযোগ প্রদান
৮। নরেন্দ্র মোদীকে সন্তুষ্ট করার জন্য ভারতের আদানি শিল্পগোষ্ঠীর কাছ থেকে অত উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয়
৯। সীমান্তে বাংলাদেশের নাগরিক হত্যায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফকে নিরব সম্মতি প্রদান
১০। ভারতের আদলে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার হিন্দুত্বকরণ
১১। বাংলাদেশের প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা “র” এর অনুপ্রবেশের অবারিত সুযোগ প্রদান

পুতুল শেখ হাসিনাকে জনগণের কোনরকম ম্যান্ডেট ছাড়াই অব্যাহতভাবে ক্ষমতায় রাখার জন্য ভারত সারা বিশ্বে ওকালতির দায়িত্ব গ্রহণ করে। ফলে একের পর এক ভুয়া নির্বাচন করলেও ২০২১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারকে কোন আন্তর্জাতিক বাধানিষেধের মুখে পড়তে হয় নাই। সেই বছর ডিসেম্বরে প্রথম বারের মত মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পুলিশ প্রধান, সেনা প্রধান, গুটিকয়েক সামরিক কর্মকর্তা এবং র‍্যাবের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করে। এতে অবশ্য ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির আরো একটি “ডামি নির্বাচন” ঠেকানো যায় নাই। কারণ, ওয়াশিংটনসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশের রাজধানীতে শক্তিশালী ভারতীয় এবং ইসরায়েলি লবি বাংলাদেশে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনে নীরব সম্মতি প্রদানের জন্য চাপ দিয়ে সফল হয়।

বাংলাদেশে ভারতীয় গোয়েন্দাদের বিপুল উপস্থিতি সত্ত্বেও তারা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ এবং জনরোষের মাত্রা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে। অবশেষে আগস্ট বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনাকে তার প্রভুদেশ ভারতেই আশ্রয় নিতে হয়েছে। ১৯৮১ সালে পুরনো বাসস্থান দিল্লি থেকে বাংলাদেশে এসে দুই দফায় ২১ বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে ইতিহাসের অমোঘ বিচারে দেশদ্রোহী শেখ হাসিনাকে অবমাননাকরভাবে পালিয়ে ৪৩ বছর বাদে দিল্লিতেই আশ্রয় নিতে হয়েছে।

শেখ হাসিনা নামক দানবের উত্থানে ভারতের ভূমিকা বর্তমানে সারা বিশ্বে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতীয় মিডিয়া এবং সে দেশের সুশীল সমাজ এতোদিন অন্ধভাবে হাসিনার ফ্যাসিবাদকে সমর্থন দিয়ে গেলেও এখন খানিকটা মুখ খুলতে শুরু করেছে।

ভারত সরকারকেও বাংলাদেশে ভয়াবহ কূটনৈতিক বিপর্যয়ের পর নতুন পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক ভূরাজনীতি নিয়ে নতুন কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। ঢাকার লজ্জাকর পরাজয়ের পর দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতীয় দাদাগিরি আর চলবে কিনা সেটা এখন বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন।

লেখক: সম্পাদক, আমার দেশ