টানা দেড় মাসের বেশি সময় ধরে বন্যার পানিতে ডুবে থাকার পর জাগতে শুরু করেছে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলো। ঘরে ফিরতে শুরু করেছে বানভাসি মানুষ। বিধ্বস্ত বাড়িঘর মেরামতের চেষ্টা করছেন। এর মধ্যেই ফের হুঙ্কার দিচ্ছে বন্যা। এক দিনের ব্যবধানে বিপৎসীমার ওপরে উঠে গেছে আরও দুটি নদীর পানি প্রবাহ। নতুন করে বন্যার পানি ঢুকতে শুরু করেছে বিভিন্ন এলাকায়। বর্তমানে চারটি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে পর্যবেক্ষণাধীন ১০১টি পানিসমতল স্টেশনের ৫১টিতে পানি বেড়েছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের গতকাল সকালের তথ্যমতে, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার পানিসমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে পানি বাড়ছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার অধিকাংশ নদীতে। এক দিনের ব্যবধানে ১০১টি পানিসমতল স্টেশনের ৫১টিতে পানি বেড়েছে। স্থিতিশীল আছে গঙ্গা-পদ্মার পানিসমতল। বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে গুড়, বাঘাবাড়ী, ধলেশ্বরী ও পদ্মা নদীর পানি। এদিকে গত ১৫ আগস্টের পূর্বাভাসে গঙ্গা-পদ্মার পানিসমতল ২৪ ঘণ্টা স্থিতিশীল থাকার কথা বলা হলেও পদ্মার পানি গতকাল সকাল নাগাদ ৬ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। এতে ফের প্লাবিত হতে শুরু করেছে দীর্ঘদিন বন্যাকবলিত থাকা জেলাগুলোর নিম্নাঞ্চল। এদিকে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি এখনো বিপৎসীমার নিচে থাকলেও নদ-নদী দুটির পানিসমতল বিভিন্ন পয়েন্টে ১ থেকে ১৩ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে যমুনার পানি বিপৎসীমার মাত্র ৩ সেন্টিমিটার নিচে রয়েছে। আর গত এক দিনে এই স্টেশনে পানি বেড়েছে ৫ সেন্টিমিটার। বৃদ্ধি একইভাবে অব্যাহত থাকলে আজই বগুড়ায় বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে যমুনার পানি। পদ্মার পানি সুরেশ্বর পয়েন্টে এক দিনে ১৫ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ১৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে গোয়ালন্দ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে বন্যাদুর্গত অধিকাংশ এলাকা থেকে পানি নেমে গেলেও দুর্ভোগে আছেন সেখানকার বাসিন্দারা। অধিকাংশ ঘরবাড়িতে এখনো কাদা-পানি। ঘরের মধ্যে, উঠানে মানববর্জ্য। ভেঙে গেছে কাঁচা ঘরবাড়ি। সেগুলো এখনো মেরামত করে বসবাসের উপযোগী করতে পারেনি অধিকাংশ মানুষ। টিউবওয়েলগুলো ব্যবহারের উপযোগী না হওয়ায় বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে খাদ্য সংকটের কারণে একবেলা খাবার জুটলে আরেক বেলা জুটছে না বানভাসি পরিবারগুলোয়। সরকারের ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রাখলেও অনেক ঘরেই তা পৌঁছাচ্ছে না। বানভাসিদের ধারণা, তাদের জন্য বরাদ্দ ত্রাণ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ঠিকভাবে বিতরণ করছেন না। আর জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, অপর্যাপ্ত ত্রাণের কারণে সবাইকে দেওয়া যাচ্ছে না।

এদিকে বন্যার পানির সঙ্গে দীর্ঘদিনের যুদ্ধে অনেকের হাতে-পায়ে ঘা দেখা দিয়েছে। ডায়রিয়া, আমাশয়ের মতো পানিবাহিত রোগ এখন ঘরে ঘরে। সব মিলে মানবেতর জীবনযাপন করছে বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষগুলো। আমাদের সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, খাদ্য-ওষুধ ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বসতভিটা মেরামতের অর্থ সংকটে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন বানভাসিরা। এর মধ্যে চতুর্থ দফা বন্যার পানি বাড়তে থাকায় নতুন করে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে নিম্নআয়ের এসব বন্যাকবলিতদের কপালে। দীর্ঘদিন বসতভিটা পানির নিচে থাকায় ঘরের নিম্নাংশের টিন, ছনের বেড়া, খুঁটি ও ঘরের আসবাবপত্র পচে নষ্ট হয়ে গেছে। ঢেউয়ের আঘাতে ঘরের মাটি সরে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এসব ঘর মেরামত করতে যে অর্থ লাগবে তার জোগান দেওয়ার সামর্থ্য নেই অধিকাংশ দরিদ্র পরিবারের। এ ছাড়াও পানি বাড়ায় নতুন করে বাঁধে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে অনেকে। ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাঁধে ঝুপড়ি তুলে মানবেতরভাবে জীবনযাপন করছেন। এদের মধ্যে আবারও চরম খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। দেখা দিয়েছে পানিবাহিত নানা রোগ। অন্যদিকে, যমুনার অরক্ষতি অঞ্চলে ভাঙনে কয়েক হাজার বসতভিটা ও সহস্রাধিক হেক্টর ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। চৌহালী উপজেলা সদর রক্ষা বাঁধে তিনটি ধস দেখা দিয়েছে। সরকারি হিসাবে চলতি বন্যায় জেলার সাতটি উপজেলার ৬৪টি ইউনিয়নের ১ লাখ ১৮ হাজার ৯৭২টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৩২৪ কিলোমিটার কাঁচা-পাকা রাস্তার ক্ষতি হয়েছে। ১৪ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। আর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে ৪৪০ মেট্রিক টন চাল, ৭ লাখ ৮৯ হাজার নগদ টাকা, ৭ লাখ টাকার শিশু খাদ্য ও ১৫ লাখ টাকার গো-খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে। স্বামী পরিত্যক্তা মর্জিনা বেগম জানান, দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে টানা দুই মাস ধরে বাঁধে আছি। আয়-রোজগারের কেউ নেই। মাত্র ৫ কেজি চাল পেয়েছিলাম। তা কবেই শেষ হয়ে গেছে। কত কষ্টে যে দিন পার করছি, তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।