- Bangladesher Shomoy | বাংলাদেশের সময়.কম - https://www.bangladeshershomoy.com -

নেপালে লালদের ঐক্য কি ক্ষয়ে যাচ্ছে?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:  নেপালের বৃহত্তম দুটো রাজনৈতিক দল – ইউনিফায়েড মার্ক্সিস্ট লেনিনিস্ট, এবং কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল-মাওয়িস্ট – একই রাজনৈতিক প্রতীক নিয়ে ২০১৭ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। তাদের বোঝাপড়া ছিল যে, নির্বাচনের ফলাফলের পর আনুষ্ঠানিকভাবে তারা ঐক্যবদ্ধ হবে। সাউথ এশিয়ান মনিটর।

২৭৫ আসনের পার্লামেন্টে ওলির নেতৃত্বাধীন দল প্রায় দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। ওলি নেপালকে উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং এই ফলাফল ছিল তার প্রমাণ যে, নেপালের জনগণ তার উপরে আস্থা রেখেছিল। তাকে বিশ্বাস করার কারণ ছিল নেপালিদের জন্য। নতুন সংবিধানের ব্যাপারে ভারত যখন নেপালকে নির্দেশনা দেয়ার চেষ্টা করেছিল এবং নেপাল তাতে রাজি না হওয়ায় ২০১৫ সালে নেপালের উপর চার মাস ধরে অর্থনৈতিক অবরোধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল, ওলি তখন জোরালোভাবে ভারতের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন।

নির্বাচনী প্রচারণার সময় ওলি বারবার বলেছেন, “যে কোন স্বাধীন দেশের জন্য সার্বভৌমত্বের অর্থ একই, তা সেটা বড় দেশ হোক বা ছোট”। বিগত আড়াই বছরে যেখানে তিনি বড় ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন, সেখানে তিন বছর পরে এসেও তিনি একইভাবে জোরের সাথে ‘সার্বভৌমত্বের মন্ত্র’ আওড়ে চলেছেন।

নেপালের দারচুলা, ভারতের উত্তরখাণ্ড ও চীনের তিব্বতের ত্রিদেশীয় সংযোগ পয়েন্টের কাছে প্রায় ৩৭০ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে ভারতের সাথে নতুন বিবাদ শুরু হয়েছে। ওলি পার্লামেন্টে বলেছেন, “আমরা যে কোন মূল্যে আমাদের ভূমি ফিরে পাওয়ার দাবি জানাবো”। এর আগে তার দল এই এলাকাকে নেপালের নতুন সরকারী মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য যে সংবিধান সংশোধনী বিল উত্থাপন করে, সেটা সর্বসম্মতভাবে পাস হয়।

গত বছর নভেম্বরে এই এলাকাগুলোকে ভারতের অংশ হিসেবে দেখিয়ে নতুন মানচিত্র প্রকাশ করে নয়াদিল্লী, এবং নেপালের প্রতিবাদকে তারা বিবেচনায় নেয়নি। এরই প্রতিক্রিয়া হিসেবে নেপাল পাল্টা মানচিত্র প্রকাশ করে। তাছাড়া আলোচনা ও কূটনৈতিক বিনিময়ের মাধ্যমে বিবাদ মিটিয়ে ফেলার জন্য সময় নির্ধারণের ব্যাপারে নেপাল দুইবার চিঠি দেয়ার পরও ভারত তাতে সাড়া দেয়নি।

এটা স্বাভাবিক যে, ভূখণ্ডগত ইস্যুর একটা ব্যাপক আবেদন রয়েছে। এই বিবাদ সকল জনগোষ্ঠি ও রাজনীতির লোকদেরকে এক জায়গায় নিয়ে এসেছে এবং কার্যকরভাবে তারা প্রধানমন্ত্রীর পেছনে দাঁড়িয়েছে, যিনি একটা শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের মুখোমুখি হয়ে আছেন। জাতীয়তাবাদ আবারও ওলির জন্য সুরক্ষার ছাতা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু কতদিন এটা থাকবে? তার পায়ের নিচের মাটি দুর্বল হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে।

শক্তিশালী স্ট্যান্ডিং কমিটির এক সিনিয়র সদস্য বলেছেন, ‘ভূখণ্ডগত ইস্যুতে আমরা সবাই এক এবং পার্লামেন্টে আমরা এই এলাকাগুলোকে নিজেদের বলে দাবি জানিয়েছি। কিন্তু আমরা আর ওলির নেতৃত্বকে মেনে নেবো না, কারণ তিনি দল ও এর সিদ্ধান্তকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করছেন”।

বুধবার ওলি অভ্যন্তরীণ চাপের কাছে নতি স্বীকার করে কমিটির বৈঠক আহ্বান করেছেন। এই কমিটি নিশ্চিতভাবে আগামী কয়েকদিন তার কঠিন সমালোচনা করবে। তারা যেটা বলছেন, সেটা হলো সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিয়ে ‘আমেরিকান স্বার্থের’ কাছে নতি স্বীকারের কারণে এই সমালোচনা করা হবে।

দিল্লীর কিছু নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও কূটনীতিক একদিকে অভিযোগ করেছে যে, ওলি ‘চীনের পুতুল’ হয়ে উঠেছেন। অন্যদিকে, দলের সহকর্মীরা দোষারোপ করছেন যে, মার্কিন স্বার্থের কাছে নতি স্বীকার করেছেন তিনি। পরস্পরবিরোধী এই অভিযোগ অদ্ভুত শোনাতে পারে, কিন্তু এর মাধ্যমে দলের অভ্যন্তরীণ অবিশ্বাস দ্বারা চালিত রাজনীতির ধরনটাও উঠে এসেছে, যেটা শেষ পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির ঐক্যকে ধসিয়ে দিতে পারে। বুধবার এর লক্ষণগুলো চোখে পড়েছে।

বর্তমান বিতর্কের সূচনা হয় যখন ওলি তড়িঘড়ি করে যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ সহযোগিতার অধীনে ৫০০ মিলিয়ন ডলার অনুদানের চুক্তি করেন। তার বিরোধীরা দাবি করেছেন যে, এখানে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নিরাপত্তা স্বার্থ জড়িত রয়েছে এবং তাদের ‘লক্ষ্য’ হলো চীনে উসকে দেয়া।

বুধবার বৈঠক শুরুর সময় প্রধানমন্ত্রী ও দলের প্রধান কে পি শর্মা ওলি বলেন যে, সিনিয়র নেতারা তাকে যথেষ্ট সমর্থন দিচ্ছেন না যদিও তিনি সমাজবাদী পথের দিকে হাঁটছেন, যে বিষয়টি নিয়ে দলের ঐক্যের সময় সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এর পরই তিনি দলের কো-চেয়ার পুস্প কমল দহল প্রচণ্ডকে দোষারোপ করেন। মাওবাদী গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন প্রচণ্ড। প্রচণ্ড জোর দিয়ে দাবি করেন যে, বিষাক্ত ক্ষমতার কারণে ওলি ‘অহংকারী’ হয়ে উঠেছেন। ভারতের বিরুদ্ধে ওলির অবস্থান কতক্ষণ তাকে রক্ষা করবে? অনুমান করা কঠিন, তবে নিশ্চিতভাবে চীন-ভারত এবং ভারত-নেপালের উত্তেজনা স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত তিনি টিকতে পারবেন না।

এটা সত্য যে ভারতের সাথে বিবাদ, দক্ষিণের প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে নেপালে ধারাবাহিক প্রতিবাদ এর চেয়ে খারাপ কোন সময়ে আসতে পারতো না। ভারতের লে. কর্নেল পর্যায়ের একজন কর্মকর্তাসহ ২০ ভারতীয় সেনার নিহত হওয়া, এবং একটা যুদ্ধকালিন পরিস্থিতি বিরাজ করছে একদিকে, অন্যদিকে নেপালকে চীনের যতটা ঘনিষ্ট ভাবছে ভারত, সেটার কারণে তাদের সাথে কূটনীতিক বিনিময় করাটা নেপালের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যদিও দুই দেশের মধ্যে নীতিগতভাবে ঐক্যমত রয়েছে যে, সীমান্ত বিবাদের ইস্যুগুলো সংলাপের মাধ্যমে, তথ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে, এবং বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীসুলভ মনোভাব নিয়ে সমাধান করা হবে, কিন্তু বাস্তবে দুই দেশের এমনকি শীর্ষ পর্যায়েও অবন্ধুসুলভ বিনিময় হয়েছে, যেটা যে কোন কাঙ্ক্ষিত ফলাফলের জন্য ক্ষতিকর।

এই ধরনের গুঞ্জনও শোনা গেছে যে, ওলি যতক্ষণ ক্ষমতায় থাকবে, ততক্ষণ নেপালের সাথে আলোচনায় বসতে চায় না ভারত। কিন্তু নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের আগের সেই প্রভাব আর নেই এবং চীন এখানে তাদের উপস্থিতি, বিনিয়োগ এবং এল ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট প্রভাবের মাধ্যমে কার্যকরভাবে ভারতের আগের প্রভাবকে আটকে দিয়েছে।

৮ মে, ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং পিথোরাগড় থেকে লিপুলেখ পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার সড়কের উদ্বোধন করেন। তিব্বতের মানসরোবরে তীর্থযাত্রীদের যাতায়াত সহজ করার জন্যেই এটা করা হয়েছে। কিন্তু ত্রিদেশীয় সংযোগ পয়েন্টের লিপুলেখকে নেপাল সবসময় নিজেদের অংশ হিসেবে দাবি করে এসেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর বর্ডার রোড অর্গানাইজেশান যে সড়কটি নির্মাণ করেছে, সেটার কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে, এবং নেপাল তাৎক্ষণিকভাবে তাদের ভূখণ্ডের উপর দিয়ে ভারতের একতরফাভাবে সড়ক নির্মাণের প্রতিবাদ জানিয়েছে। কিন্তু ভারত এই প্রতিবাদকে তাৎক্ষণিকভাবে নাকচ করে দিয়েছে।

এর এক সপ্তাহ পর, ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান এম এম নারাভানে দাবি করেন যে, এই সড়ক ভারতীয় ভূখণ্ডের উপর দিয়ে গেছে এবং নেপাল যে প্রতিবাদ জানাচ্ছে, সেটা অন্য কারো ইঙ্গিতে করা হচ্ছে, যেখানে তিনি প্রচ্ছন্নভাবে চীনের দিকে ইঙ্গিত করেন। এর পরে রাজনাথ সিং এবং জেনারেল নারাভানে উভয়েই নেপালকে শান্ত করার চেষ্টা করেন এবং বলেন যে, দুই দেশের মধ্যে পুরনো, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে, এবং যে কোন ইস্যুর সমাধান আলোচনার মাধ্যমে হতে পারে। তবে, নেপালের রাজনীতিতে ‘সার্বভৌমত্বের সমতার’ ইস্যুটি প্রাধান্য পেয়েছে।

পরের মাসেই ভারত-চীন উত্তেজনা বেড়ে যায়। চলমান এই সঙ্ঘাতের ব্যাপারে নেপালের অবস্থানও অর্থহীন হবে না। ভারত কি তিন ফ্রন্ট – চীন, পাকিস্তান ও নেপালের দিক থেকে প্রতিকূলতার মুখোমুখি হবে, যেমনটা চীনের কিছু জায়গা থেকে বলা হচ্ছে? আনুষ্ঠানিকভাবে, নেপাল বলেছে যে, তাদের দুই প্রতিবেশীরই উচিত শান্তিপূর্ণ ও সংলাপের মাধ্যমে বিবাদ মিটিয়ে ফেলা। কিন্তু বড় দুজনের মধ্যে যেখানে উত্তেজনা বেড়েছে, সেখানে নেপালের দুর্বল কণ্ঠস্বর খুব একটা গুরুত্ব পাবে না।

নেপালি গুর্খারা ভারতের সেনাবাহিনীর একটা শক্তিশালী ও অনিবার্য অংশ এবং কোন সন্দেহ নেই যে, উত্তেজনা বাড়লে তারা সামনের সারিতে থাকবে। ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে শক্তিশালী একটি গ্রুপ চায় যাত গুর্খাদের আর ভারতের সেনাবাহিনীতে পাঠানো না হয়। এই চর্চাটা শুরু হয়েছিল ১৮১৬ সালে, যখন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে নেপালের চুক্তি হয়েছিল। পরে ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পরে ভারতও এই চুক্তি জারি রাখে।

ভারত নেপালের সম্পর্কে টানাপড়েন রয়েছে এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা অস্বাভাবিক নয়, এ অবস্থায় উত্তরের দিকে দৃশ্যমানভাবে ঝুঁকতে পারে নেপাল। কারণ ভারত বারবার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে, এবং ২০০৫ সালের পরে নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে, ইউরোপিয়ান দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জোটের ক্ষেত্রে সেটা আরও খোলামেলাভাবে করা হয়েছে। ‘সার্বভৌমত্বের সমতার ভিত্তিতে যে কোন দেশের সাথে বিবাদের মীমাংসা করতে চায় নেপাল’, সম্প্রতি সিপিসি’র আন্তর্জাতিক ডিভিশনের নেতাদেরকে এ কথা বলেছেন প্রচণ্ড। বর্তমান সঙ্কটে চীন যে বৈশ্বিক নেতৃত্বের গুণাবলী দেখিয়েছে, তারও প্রশংসা করেন তিনি।

ভারতের সাথে ওলির দ্বন্দ্ব, এমসিসি বাস্তবায়িত না হলে যুক্তরাষ্ট্রে তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা, এবং দলের মধ্যে তার বিরুদ্ধে যে ভিন্নমত তৈরি হয়েছে, এই সবকিছুর কারণে তাকে নেতৃত্ব হারাতে হতে পারে। কিন্তু সেটা একই সাথে দলের ঐক্যের উপরও প্রভাব ফেলতে পারে, যেটার ফলশ্রুতিতে নেপাল আবারও অস্থিতিশীল রাজনীতির পথে ফিরে যাবে।