- Bangladesher Shomoy | বাংলাদেশের সময়.কম - https://www.bangladeshershomoy.com -

নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধি, ভালো নেই সাধারণ মানুষ

বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে পল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে জিনিসপত্রের দাম। বাজারের প্রতিটি পণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। ঊর্ধ্বমুখী বাজারে এমন কোনো পণ্য নেই, যার দামে স্বস্তি রয়েছে। তবে, বাজারে আসতে শুরু করেছে শীতের সবজি। ফলে কমতে শুরু করেছে শাক-সবজি দাম।

অন্তর্বর্তী সরকার বাজারের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেঁয়াজ, আলু, ভোজ্য তেল, চিনি, ডিম ও চাল আমদানিতে শুল্ককর ছাড় দিয়েছে। সরকার এত পণ্যের শুল্ককর ছাড় দেওয়ার পরেও গত এক মাসের ব্যবধানে শুধু ডিমের দাম কিছুটা কমেছে। বাজারে পেঁয়াজ, ভোজ্য তেল, চিনি, আলু ও চালের দাম বেড়েছে।

শুল্ককর কমার পর বাজারে পণ্যগুলোর দাম সহনীয় পর্যায়ে আসবে এমনটাই সাধারণ মানুষ আশা করেছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন ভিন্ন কথা।

ব্যবসায়ীদের দাবি, শুল্ক ছাড় পাওয়া পণ্যগুলোর মধ্যে সব পণ্য এখনো বাজারে আসেনি। আর বর্তমানে বিশ্ববাজারেও দাম বাড়ছে এসব পণ্যের। বাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন অন্যকথা, তারা বলেন, যেমন পিঁপড়ায় খায়, লাভের গুড়, তেমনি শুল্ককর ছাড়ের সুফল ভোগ করছেন ব্যবসায়ীরা।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) এক মাস আগের বাজারদর পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আমদানিতে শুল্ককর ছাড় পাওয়া ছয়টি পণ্যের মধ্যে পাঁচটিই বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। শুধু একটি পণ্য ডিমের দাম কিছুটা কমেছে। বর্তমানে প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজ খুচরায় ১১০ থেকে ১৩০ টাকায় এবং আমদানি করা পেঁয়াজ মানভেদে ৮০ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও টিসিবির হিসাবে এক মাস আগে দেশি পেঁয়াজ ১০৫ থেকে ১১৫ টাকায় এবং আমদানি করা পেঁয়াজ ৯০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

তবে টিসিবির বাজারদরের চেয়ে রাজধানীর খুচরা বাজারে ক্রেতা সাধারণকে আরও বেশি দামে এসব পণ্য কিনতে হচ্ছে। শুক্রবার খুচরায় প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হয় এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ১১০ থেকে ১২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

সরকার গত ৮ ও ১৭ অক্টোবর দুই দফায় চিনির শুল্ককর কমায়। দ্বিতীয় দফায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, চিনি আমদানিতে খরচ কমবে কমবেশি ১১ টাকা। কিন্তু সরকারি সংস্থা টিসিবির বাজারদরের তথ্য বলছে, এক মাস আগের তুলনায় খোলা চিনি কেজিতে পাঁচ টাকা পর্যন্ত বেড়ে ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

তবে খুচরা বাজার ও দোকানভেদে বর্তমানে প্রতি কেজি খোলা চিনি ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায়। ভোজ্য তেলের দাম বাড়তে শুরু হওয়ায় চলতি মাসে আমদানিতে শুল্ককর ছাড় দেয় সরকার। টিসিবি বলছে, খোলা সয়াবিন তেল লিটারে ছয় থেকে ১১ টাকা বেড়েছে এক মাসে। বর্তমানে বাজারে খোলা সয়াবিন প্রতি লিটার ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে বোতলজাত তেলের দাম বাড়েনি।

এক মাসের ব্যবধানে কেজিপ্রতি আলুর দাম পাঁচ টাকা বেড়ে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। যদিও খুচরা বাজারে কিছু দোকানে আলু কেজি ৭০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হতে দেখা গেছে।

নিম্ন আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি চাপে পড়ে চালের দাম বাড়লে। সম্প্রতি সরকার চাল আমদানিতে শুল্ককর ছাড় দেয়। শুল্ককর কমানোর ফলে আমদানি পর্যায়ে প্রতি কেজি চালের দাম ১৪ টাকা ৪০ পয়সা কমবে। যদিও এখনো চাল আমদানি শুরু হয়নি। টিসিবির বাজারদরের তথ্য বলছে, শুল্ক ছাড়ের পর কেজিপ্রতি মাঝারিমানের চালের দাম নতুন করে দুই টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। চালের বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পরিস্থিতি বুঝে চালের আমদানি বাড়াতে হবে। যাতে বাজারে সরবরাহে কোনো সংকট তৈরি না হয় এবং ঘাটতির আশঙ্কা থেকে মিল মালিকরাও সুযোগ নিতে না পারেন।

এদিকে শুল্ক ছাড়ের পর ভারত থেকে ডিম আমদানি শুরু হয়েছে। সরকার বাজারে নজরদারিও করছে। এতে বাজারে ডিমের দাম কমে এসেছে। টিসিবির তথ্য বলছে, এক মাস আগের তুলনায় হালিপ্রতি ফার্মের ডিমের দাম পাঁচ টাকা পর্যন্ত কমেছে। বর্তমানে প্রতি হালি ডিম বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকায়।

সাধারণ মানুষ কেমন আছেন?

প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করা আল আমিন নামের এক ব্যক্তি বলেন, আমার মাসিক আয় ২0 হাজার টাকা। মা এবং ছোট ভাই নিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে প্রতিমাসেই পাঁচ-ছয় হাজার টাকা ঋণ করতে হয়।

তিনি বলেন, আমি এখন ঋণে ডুবে যাচ্ছি। আগেই জিনিসপত্রের দাম বাড়তি ছিল। এখন আরও বাড়ছে। এক মাসেও একবার গরুর মাংস খেতে পারি না। ব্রয়লার মুরগিরও দাম বেশি। ডিমের দাম বেশি হলেও সপ্তাহে একদিন খেতে পারি। দুধের কথা চিন্তাও করতে পারি না।

তিনি আক্ষেপ করে আরও বলেন, বাজারের যে কী অবস্থা তা বলার ভাষা নেই। আমরা যারা নিম্ন আয়ের মানুষ, তাদের এখন টিকে থাকতেই কষ্ট হচ্ছে। আর তার মধ্যে ভাইটা লেখাপড়া করে। সংসারের একটা পূরণ হয় তো আরেকটায় টান পড়ে। অসুখ-বিসুখ হলে তো রীতিমতো ভিক্ষা করতে হবে।

একই পরিস্থিতির শিকার মহিন। তিনি ঢাকার বাইং হাউজে চাকরি করেন। বেতন পান ১৮ হাজার টাকা। দুই মেয়ে, স্ত্রী ও মাকে নিয়ে তার সংসার।

তিনি বলেন, আমার যা আয় হয় তাই ব্যয়। হাতে কোনো টাকা থাকে না। যা আয় করি তাই দিয়ে কোনোমতে সংসার চালাই। তবে এখন সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। গত মাসে মাত্র একবার মাংস খেয়েছি। এই মাসে খাই নাই। শাক-সবজি খেয়েও বাঁচার উপায় নাই। কারণ, তার দামও বাড়তি। ১০০ টাকার নিচে কেনো সবজি নাই। সামনের দিনগুলোতে যে কীভাবে চলবে বুঝে উঠতে পারছি না।

কোম্পানিও বেতন বাড়াতে পারবে না বলে দিয়েছে। আমাদের কোনো ভবিষ্যৎও নাই, পরিকল্পনাও নাই।

রিকশাচালক করিম দুঃখ করে বলেন, এরই মধ্যে ৫০ হাজার টাকা ঋণ করে ফেলেছেন। ছয় মাসের মধ্যে আমাকে এই ঋণ শোধ করতে হবে। আশা করি, শীতকালে ট্রিপ বাড়বে, আয়ও বাড়বে। তখন কিছু ঋণ শোধ করতে পারব।

ছয় জনের সংসার তার। প্রতিদিন ছয়-সাতশ’ টাকা গড়ে আয় করেন তিনি। মাসে ১৬-১৭ হাজার টাকা। এই টাকায় পরিবারের খরচ মেটানো সম্ভব নয়। তাই খরচ কমাতে পরিবারের সবাইকে গ্রামের বাড়ি নাটোর পাঠিয়ে দিয়েছেন। তারপরও কুলাতে পারেন না। তার একারই মাসে মেস ভাড়াসহ সব মিলিয়ে খরচ হয় ৮-১০ হাজার টাকা। তাই প্রতিমাসেই ঋণ করতে হয়।

খাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গরুর মাংস খেয়েছি গত কোরবানির ঈদে। তার পর আর খাইনি। শাক-সবজি, ডিম, মাছ মাংস সব কিছুর দামই বেশি। কম খেয়ে থাকতে হয় এখন। মাঝে মাঝে না খেয়ে কাটিয়ে দেয়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ৫৮ কর্মকর্তার নেতৃত্বে দেশব্যাপী অভিযান শুরু করেছে ভোক্তা অধিদপ্তর। তাতে বাজারে বিছুটা ইতিবাচক প্রভাব পড়লেও সিন্ডিকেট এখনো সক্রিয় বলে জানান কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সিনিয়র সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন।

তিনি বলেন, নিম্ন আয়ের মানুষ অনেক কষ্টে আছেন। অনেকে কম খেয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। আবার কেউ কেউ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন।

তিনি আরও বলেন, নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু নানা সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ফলে তারা মাঝখান থেকে দাম বাড়িয়ে মুনাফা করছে বিভিন্ন পণ্যে। এখানে উৎপাদকরা তেমন কিছু পাচ্ছেন না। সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে পণ্যের দাম বেঁধে দিলেও ইতিবাচক ফল পা ওয়া যাবে না।

জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক ফকির মুহাম্মদ মুনাওয়ার হোসেন বলেন, বাজারে বিভিন্ন পণ্যের অদৃশ্য সিন্ডিকেটও আছে। তাদের অনেক সময় চিহ্নিত করা যায় না। কারণ, তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট লোকেশন বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নাই। তারা ফোন এবং অনলাইনে সিন্ডিকেটবাজি করে। ফলে ডিমসহ যেসব পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে, সেই দামে বাজারে পণ্য পাওয়া যায় না। এটা কঠিন। আমরা এরই মধ্যে ওই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িতদের এক অংশকে চিহ্নিত করেছি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি বলেন, প্রতি জেলায় জেলায় টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। অভিযানের পাশাপাশি আমরা পণ্যের সরবরাহ লাইন নিরবচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করছি। শুধু অভিযানে কাজ হয় না। সরবরাহ লাইন ঠিক না থাকলে বাজারে নতুন করে সংকট তৈরি হতে পারে।