- Bangladesher Shomoy | বাংলাদেশের সময়.কম - https://www.bangladeshershomoy.com -

নদী খননে বিপর্যয়ের শঙ্কা

প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প নদী খননের মূলধনী যন্ত্রপাতি ড্রেজার মেশিন আমদানিতে ২৯ শতাংশ করারোপ হওয়ায় ড্রেজিং খাতে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। প্রস্তাবিত বাজেটে এমন পদক্ষেপে হুমকিতে পড়েছে বেসরকারি খাতের ৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় প্রতি বছর সারা দেশের নদীসমূহে যে ৮ হাজার কোটি টাকার খনন কাজ হয়, তাতেও অনিশ্চয়তা দেখা দেবে। সরকারের খরচ বাড়বে কয়েকগুণ। ড্রেজিং খাতে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হস্তক্ষেপের আশঙ্কাও করছেন ব্যবসায়ীরা।

তথ্যমতে, আসছে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে নদী খননের মূলধনী যন্ত্রপাতি হিসেবে ব্যবহৃত ড্রেজার মেশিনের আমদানি শুল্ক বা কাস্টমস ডিউটি এক শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে মূলধনী যন্ত্রপাতি হিসেবে ড্রেজার আমদানিতে যে রেয়াতি কর সুবিধা ছিল, তাও বাতিল হয়েছে। ফলে এই ৫ শতাংশ আমদানি শুল্করোপ ও রেয়াতি কর সুবিধা বাতিল হওয়ার ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আরও ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৪ শতাংশ আগাম কর এবং ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়করসহ মোট ২৯ শতাংশ কর পরিশোধ করতে হবে। এর সঙ্গে সুদ যুক্ত করলে এর পরিমাণ ৩০ থেকে ৩১ শতাংশ হতে পারে বলে মনে করেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে উন্নতমানের ইউরোপিয়ান ড্রেজার আসুক, তা একটি স্বার্থান্বেষী মহল চান না। বাড়তি করারোপে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প ড্রেজিং কাজে খরচ অনেক বেড়ে যাবে। রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় হবে। দেশে যতগুলো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আছে, তাদের সবারই ড্রেজার উন্নতমানের। কিন্তু দেশে তৈরি স্থানীয় ড্রেজারগুলো খ্বুই নিম্নমানের হওয়ায় এক থেকে দেড় বছরেই নষ্ট হয়ে যায়। খনন কাজও ভালো হয় না। কিন্তু ইউরোপীয় ড্রেজারের দাম বেশি হলেও ১০ থেকে ১৫ বছর দীর্ঘস্থায়ী হয়। এখন পর্যন্ত সরকার যত টাকার ড্রেজার মেশিন কিনেছে, তার চেয়েও অর্ধেক কিনেছে বেসরকারি খাত। প্রায় ৪০টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ২০০টির মতো উন্নতমানের ড্রেজার রয়েছে। ফলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কাটার সাকশন ড্রেজারস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন এমপি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অযৌক্তিক ও অন্যায়ভাবে ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৯ শতাংশ কর নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। ড্রেজিং ব্যবসা বিদেশিদের হাতে চলে যাবে। তার মতে, নদী খনন প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প। আগে যেখানে চর হয়েছিল, সেখানে এখন নৌযান চলাচল করছে। নদী খননে মাছের উৎপাদন বেড়েছে বলেও মনে করেন এফবিসিসিআইর সাবেক এই সভাপতি। বাংলাদেশ কাটার সাকশন ড্রেজারস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি বশির আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ড্রেজার আমদানিতে ২৯ শতাংশ কর দিয়ে ব্যবসা হবে না। কারণ, ৩০ কোটি টাকায় একটি ড্রেজার আমদানি করে এবং তাতে ২৯ শতাংশ কর দিলে দাম পড়বে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। এর আগে বাংলাদেশ কাটার সাকশন ড্রেজারস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন গত ১৬ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে দেওয়া পত্রে বলেছে, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে ড্রেজারের স্বল্পতার কারণে প্রতি অর্থবছরের জন্য নির্ধারিত খনন কাজ সম্পাদন করা সম্ভব হয় না। উপরন্তু অনাকাক্সিক্ষত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অতিবৃষ্টি ও বন্যার ফলে ক্ষেত্রবিশেষে জরুরি ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন হয়। সরকারি স্বল্পসংখ্যক ড্রেজার দিয়ে নদী খনন সম্ভব না হওয়ায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে খনন কাজ সুনামের সঙ্গে বাস্তবায়ন হচ্ছে। ফলে বেসরকারি অংশীদার হিসেবে বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান টেন্ডারের মাধ্যমে খনন কাজ করছে। এ জাতীয় খননের কাজে ব্যবহৃত ড্রেজারগুলো দেশে তৈরি হয় না। তাই বিদেশ থেকে উচ্চতর মূল্যে আমদানি করতে হয়। সংগঠনটি বলেছে, নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলোর পূর্ণতা এবং নাব্যতা রক্ষার্থে নৌযান চলাচলের সুব্যবস্থা করার জন্য জাতীয় পর্যায়ে এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় দেশের মৃতপ্রায় নদ-নদীর নবজাগরণের চেষ্টা চলছে। বর্তমানে এই কার্যক্রমের অধীনে বাংলাদেশের অনেক নদ-নদী ও খালের নাব্যতা ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম চলছে। এই কার্যক্রমকে চলমান রাখার স্বার্থে নদী খনন যন্ত্র কাটার সাকশন ড্রেজারস অতি আবশ্যক। ড্রেজার ছাড়া নদ-নদী খনন সম্ভব নয়।
সংগঠনটি বলেছে, আমেরিকান বা ইউরোপিয়ান ড্রেজারগুলোর দাম ক্ষেত্রবিশেষ কমপক্ষে ২০ কোটি টাকা। চীনের তৈরি ড্রেজারগুলোর দাম ক্ষেত্রবিশেষ কমপক্ষে ৮ কোটি টাকা। আমদানি পর্যায়ে প্রস্তাবিত ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেটে ড্রেজারের এইচএস কোড ৮৯০৫.১০.০০ অনুযায়ী, আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ করা হয়েছে এবং গত ৩ জুন মূলধনী যন্ত্রপাতি এসআরও ১২১-আইন/২০২০/৭২/কাস্টমস হতেও বিলুপ্ত করা হয়েছে। বিগত অর্থবছরে ড্রেজার আমদানি পর্যায়ে শুধু এক শতাংশ শুল্ক করে শুল্কায়ন হতো এবং ২০১৭ সালের ১ জুনের এসআরও নং ঃ ১২৮-আইন/২০১৭/১৪/কাস্টমসের আওতায় মূলধনী যন্ত্রপাতি হিসেবে রেয়াতি হারে শুল্কায়ন করা হতো। সংগঠনটি বলেছে, প্রস্তাবিত বাজেটে ড্রেজার আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ ও এর সঙ্গে অন্যান্য শুল্ক করসহ শুল্কায়ন করার কথা বলা হয়েছে। ফলে আমদানি পর্যায়ে প্রতিটি ড্রেজারে প্রায় ৬ থেকে ৭ কোটি টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত শুল্ক কর পরিশোধ করতে হবে। আমদানি হওয়া ড্রেজারগুলো বাংলাদেশে তৈরি করাও সম্ভব নয়। প্রতিটি ড্রেজার মেশিনের বাণিজ্যিক মূল্য কমপক্ষে ২০ কোটি টাকা। এই পরিমাণ অর্থে দেশে একটি ছোট-খাটো শিল্পপ্রতিষ্ঠানও তৈরি করা যায়।

সংগঠনের মতে, নদী খনন বর্তমান সরকারের একটি অগ্রাধিকার খাত হওয়ায় অতিরিক্ত করের কারণে এই কার্যক্রম ব্যাহত হবে। তাই শুধু ড্রেজার এইচএস কোড ৮৯০৫.১০.০০ মূলধনী যন্ত্রপাতি এসআরও ১২১-আইন/ ২০২০/৭২/কাস্টমসে অন্তর্ভুক্ত করা অতি আবশ্যক। আমদানি হওয়া ড্রেজার মেশিনের এইচএস কোড ৮৯০৫.১০.০০-কে বিগত অর্থবছরের আলোকে নতুন অর্থবছরেও ঘোষিত মূলধনী যন্ত্রপাতি সংক্রান্ত এসআরও নং ঃ ১২১-আইন/২০২০/৭২/কাস্টমসে অন্তর্ভুক্ত করে কাস্টমস ডিউটি বা আমদানি শুল্ক এক শতাংশ এবং অন্যান্য সুবিধাসহ বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে বিশেষ অনুরোধ করেছে কাটার সাকশন ড্রেজারস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন।

জানা গেছে, সারা দেশে প্রতি বছর যে ৮ হাজার কোটি টাকার নদী খনন কাজ হয়, তা মূলত নৌপরিবহন ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। দুই মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগী ভূমিকায় নদীতে আগের চেয়ে মাছের উৎপাদনও বেড়েছে। সরকার নৌপথে পণ্য পরিবহন ও মানুষের চলাচল সচল রাখতে চায়। এর মধ্য দিয়ে অর্থনীতির গতিশীলতাও বাড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এমন প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প নদী খননের মূলধনী যন্ত্রপাতি ড্রেজার মেশিন আমদানিতে শুল্ক কর পুনরায় ১ শতাংশ বহাল রাখার দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

এ প্রসঙ্গে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রস্তাবিত বাজেট সংসদে পেশ হওয়ায় এখন জনপ্রতিনিধিরা বিষয়টি পর্যালোচনা ও বিবেচনা করবেন বলেই আশা করছি। এর পরেই বিষয়টি নিয়ে আমরা আলোচনা করব।

নদী খননের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক গত ১৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে বলেন, দেশের ৬৪ জেলার ৩৭৫টি উপজেলায় ১ম পর্যায়ে ৪৪৮টি ছোট নদী ও খাল এবং জলাশয় খনন ও পুনঃখনন করা হচ্ছে। ২য় পর্যায়ে ১৩ হাজার ৮৮৫ দশমিক ৩৬৩ কিলোমিটার ছোট নদী ও খাল পুনঃখনন করা হবে। প্রথম পর্যায়ে দেশের ৩৭৫টি উপজেলা ও ২টি সিটি করপোরেশনের ৫৬১টি প্যাকেজের মাধ্যমে ৪ হাজার ৮৬ দশমিক ৬২২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ৮৮টি ছোট নদী ৩৫২টি খাল ও ৮টি জলাশয় পুনঃখনন করা হবে।

পানিসম্পদ আইন কার্যকরের লক্ষ্যে সরকারের ‘বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ অর্থাৎ বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান অনুযায়ী, স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। দেশের নদ-নদীর পানি দূষণরোধে একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। নৌ চলাচল সহজ করার মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। পর্যায়ক্রমে দেশের সব মৃতপ্রায় নদী উদ্ধার কার্যক্রমের অধীনে নদীর কাজ পুনঃখনন করা হচ্ছে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে গত বছর ১০ ডিসেম্বর উপস্থাপিত তথ্যে বলা হয়, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে সারা দেশে ৩৮টি নদীর ৪৫০ কিলোমিটার খনন কাজ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। তবে এখন পর্যন্ত এ কাজের ৩১ দশমিক ২৮ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি তাদের ২৬ সেপ্টেম্বরের সভায় ডেল্টা প্ল্যান অনুযায়ী- দেশের সব নদী খননের মাধ্যমে নদীর নাব্যতা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে। এতে ড্রেজিং কার্যক্রম অব্যাহত রাখা, অতি ঝুঁকিপূর্ণ নদী ভাঙন চিহ্নিত এলাকায় পরবর্তী বছর বন্যা মোকাবিলার জন্য আগাম প্রস্তুতি গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়। সংসদীয় স্থায়ী কমিটি তাদের গত ২৫ আগস্টের সভায় পানিপ্রবাহ ঠিক রাখতে নদী পুনঃখনন কার্যক্রম অব্যাহত রাখার সুপারিশ করেছে। এতে দেশের সব নদীর ডুবোচর পর্যায়ক্রমে কেটে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি এবং প্রতি বছর তা অব্যাহত রাখার সুপারিশ করা হয়।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন