• ফাখরিজাদে (বামে) ও সোলাইমানি (ডানে)

ড. সোহেল আহম্মেদ: মেয়ে ফাতিমার কাছে জেনারেল কাসেম সোলাইমানির লেখা একটি চিঠি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। বাবার প্রথম শাহাদাৎ বার্ষিকীর প্রাক্কালে ফাতিমা নিজেই তা প্রকাশ করেছেন। মেয়ের কাছে লেখা চিঠিতে তিনি বারবারই মৃত্যুকে আলিঙ্গনের আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরেছেন।

চিঠিতে এটা স্পষ্ট-তিনি মৃত্যুর জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে পবিত্র মুহূর্তটির অপেক্ষায় ছিলেন। জেনারেল সোলাইমানি মৃত্যুকে আলিঙ্গনের আকুতি জানিয়ে চিঠির একাংশে লিখেছেন, ‘মৃত্যুর মুহূর্তটি খুবই উপভোগ্য! এই মুহূর্তটি আমার পরম ভালোবাসার। হে খোদা, আমি ৩০ বছর ধরে এই মুহূর্তটির জন্য চেষ্টা চালিয়েছি। সুপারিশকারীদের শরণাপন্ন হয়েছি। হে মৃত্যু, হে প্রিয়তম তুমি কোথায়?’ ফাতিমার কাছে লেখা সোলাইমানির চিঠিটি পড়ে মনে হলো- মৃত্যু যেন তাঁর কাছে অনন্ত সুখের হাতছানি, সুন্দর-সুরম্য বর্ণিল ঠিকানা। মৃত্যুকে আলিঙ্গনের জন্য কেউ এভাবে আকুতি জানাতে পারে তা কাসেম সোলাইমানির বক্তব্য না শুনলে বা চিঠি না পড়লে আমি হয়তো কখনও বিশ্বাসই করতাম না। এখনও যখনই ভাবি যেকোনো মুহূর্তে আমার মৃত্যু হতে পারে। তখনি এক অজানা ভয় আঁকড়ে ধরে। মনে হয় পৃথিবীকে বিদায় জানানোর মতো কোনো প্রস্তুতিই এখনও সম্পন্ন করা হয়নি। জেনারেল সোলাইমানি অনেক আগেই সে প্রস্তুতি সম্পন্ন করে পবিত্র মৃত্যুর পেছনে ছুটেছেন। কিন্তু মৃত্যুই যেন তাকে ধরা দিতে ভয় পেয়েছে। মৃত্যুই যেন এই মহাবীরকে আলিঙ্গনের সাহস হারিয়ে ফেলেছিল!

কাসেম সোলাইমানি নিজের মৃত্যু বলতে সব সময় শহীদী মৃত্যুকে বুঝিয়েছেন। তাঁর ছেলে আলী রেজা গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘বাবার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা হতো। বাবা কথায় কথায় বলতেন তিনি শহীদ হওয়ার জন্য ছুটে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু শাহাদাৎ তাকে ধরা দিচ্ছে না।’ স্বামীর মৃত্যুর পর কাসেম সোলাইমানির স্ত্রী এক কবিতায় লিখেছেন, ‘সোলাইমানি শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পাহাড়-পর্বত ও মরুভূমিতে ঘুরে বেড়িয়েছেন। অবশেষে তার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়েছে।’ কয়েক বছর আগে সিরিয়ার আলেপ্পোতে জঙ্গি-বিরোধী যুদ্ধে গিয়ে শহীদ হয়েছেন ইরানের হোসেন মেহরাবি। তার মেয়ে যেইনাব মেহরাবি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন,ইরানের সর্বোচ্চ নেতার বাড়িতে কাসেম সোলাইমানিকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। জেনারেল সোলাইমানিকে সামনে পেয়ে তাঁর হাতের আংটিটি চেয়ে বসেছিলাম। বলেছিলাম, চাচা আপনার আংটিতো বেশ সুন্দর। ওটা কি আমাকে দেবেন? আংটি তিনি ঠিকই দিয়েছিলেন, কিন্তু শর্তসাপেক্ষে। আংটিটি তিনি আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, আংটি আমি দিচ্ছি, কিন্তু শর্ত হলো আমি যাতে শহীদ হতে পারি সেই দোয়া তোমাকে করতে হবে। যেইনাব আংটিটি নেয়ার পর শর্তের কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এ কারণে আবার জেনারেল সোলাইমানির কাছে ফিরে গিয়ে বলেন, চাচা, এই শর্ত মেনে আংটি আমি নিতে পারব না। কারণ আপনার জন্য এ ধরণের দোয়া করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি চাই ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার আগে আপনি এ পৃথিবী ছেড়ে কোথাও যাবেন না। জেনারেলের উত্তর ছিল, ‘মাগো আমি শহীদ হতে চাই। শাহাদাতই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা।’

২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি জেনারেল সোলাইমানির জীবনের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়। শেষ পর্যন্ত পরম কাঙ্ক্ষিত মৃত্যু তাকে ধরা দেয়। ওই ঘটনার পর এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। প্রতিনিয়তই তার জীবন ও অবদান নিয়ে আলোচনা ও বিশ্লেষণ হচ্ছে। সোলাইমানির কথা উঠলেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রসঙ্গও সামনে আসে। ট্রাম্প সরাসরি জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যার দায় স্বীকার করেছেন। আত্মস্বীকৃত এই খুনি এখন দিশেহারা। জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার মাধ্যমে ট্রাম্প যেসব উদ্দেশ্য হাসিল করতে চেয়েছিলেন তার মধ্যে একটি ছিল- ২০২০ সালের নির্বাচনে ইসরাইলি লবির পূর্ণাঙ্গ সমর্থন নিয়ে যে করেই হোক ক্ষমতায় টিকে থাকা। কিন্তু আরও চার বছর হোয়াইট হাউসে থাকার সেই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়নি ট্রাম্পের। নানা গ্লানি নিয়ে তাকে রাজনীতির মঞ্চ ছাড়তে হচ্ছে। সোলাইমানিদের মতো বীরদের সঙ্গে কোনো ক্ষেত্রেই ট্রাম্পের মতো নির্লজ্জদের তুলনা চলে না। তবু এটুকু তুলনা না করলেই নয়। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্র ও দেশের বাইরে যে গতিতে নিন্দিত ও ঘৃণিত হচ্ছেন ঠিক সে গতিতেই সোলাইমানির প্রতি ইরান ও এর বাইরের জগতের মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা বাড়ছে। সোলাইমানি শাহাদাতের পর যেন আরও বেশি শক্তিমান হয়ে উঠেছেন।

সোলাইমানির মৃত্যুর আগে তাঁকে এতো গভীরভাবে চেনার সুযোগ হয়নি ইরানিদের। বাইরের গণমাধ্যমে তার বীরত্ব নিয়ে নানা লেখালেখি হলেও নিজেকে সব সময় লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন প্রচার-বিমুখ এই বীর। এ কারণে দেশের গণমাধ্যমে তাঁকে খুব একটা দেখা যেত না। সম্প্রতি সন্ত্রাসী হামলায় শহীদ পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদে’র মধ্যেও একই বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে। মৃত্যুর আগে ফাখরিজাদেকেও ইরানের সাধারণ মানুষ খুব একটা চিনত না। মিডিয়ার সামনে এসে পরিচিতি পাওয়ার কোনো আগ্রহ তার মধ্যে ছিল না। ট্রাম্প গংরা এই বিজ্ঞানীর প্রাণও কেড়ে নিয়েছে। ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান এক বিশ্লেষণে লিখেছে, ইসরাইল ফাখরিজাদে-কে হত্যা করে থাকলে অবশ্যই ট্রাম্পের সম্মতি নিয়েই করেছে। ফাখরিজাদেও ছিলেন মৃত্যুর জন্য সদাপ্রস্তুত এক পরমাণু বিজ্ঞানী। প্রায় ২০ বছর আগে প্রথম হামলার শিকার হন তিনি। এরপর থেকে প্রতিনিয়ত তাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। তিনি যখনি বাড়ির বাইরে যেতেন তখনি তার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় থাকতেন তার স্ত্রী-সন্তানেরা। কিন্তু ফাখরিজাদে মৃত্যুর ভয় করতেন না। দেহরক্ষীরা যখনই বলতেন আগামী কয়েক দিন বাড়ির বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না, তখনি তিনি অসন্তুষ্ট হতেন। ঝুঁকি নিয়েও কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল থাকতেন। যেদিন তিনি শহীদ হলেন সেদিনও তার দেহরক্ষী দলের প্রধান তাকে বলেছিলেন, ‘স্যার আজ আপনি এখানেই থেকে যান। আজ বাইরে বের না হলে ভালো হয়। কিন্তু ফাখরিজাদে দেহরক্ষীদের বললেন, আজ আমার যেতেই হবে। আমার ক্লাস নিতে হবে, ক্লাস নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি জরুরি। কিছু পড়াশোনাও করা দরকার। কিন্তু আমি এখন যেখানে আছি সেখান থেকে এসব কাজ করা সম্ভব নয়।’ দেহরক্ষীরা বিজ্ঞানীর কথা মেনে নিয়ে তার সহযাত্রী হলেন। কিন্তু সেদিন আর অক্ষত ফিরতে পারেননি ফাখরিজাদে।

ফাখরিজাদে’র মতো বিজ্ঞানীরা গোটা বিশ্বের সম্পদ। ফাখরিজাদে কোনো মানুষের জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছিলেন এমন কোনো প্রমাণ কেউ দিতে পারবে না। মানুষের কল্যাণে গবেষণা করতেন তিনি। করোনার টিকা তৈরির কাজও এগিয়ে নিচ্ছিলেন। প্রচার-বিমুখ সোলাইমানির পর অনেকটাই অপরিচিত মুখ ফাখরিজাদে’র নীরব কার্যক্রম সম্পর্কে জানার পর এটা বলা যায়, ইরানে এ ধরণের আরও অনেকেই রয়েছেন যাদের হয়তো আমরা চিনি না। তারাই সোলাইমানি ও ফাখরিজাদের মতো লোকদের মিশন এগিয়ে নিয়ে যাবেন অগোচরে। ফলে সোলাইমানিদের প্রস্থানে খুব বেশি হতাশ হওয়ার যৌক্তিকতা নেই বরং তাদের এমন প্রস্থান নতুন প্রজন্মকে আলোড়িত করে। সোলাইমানিদের মৃত্যু যেহেতু অপ্রস্তুত-মৃত্যু নয়, সে কারণে তারা শূন্যতা তৈরি করে বিদায় নেন না। তাদের মৃত্যু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রাণ সঞ্চারীর ভূমিকা পালন করে। সোলাইমানিদের মৃত্যু কখনো কখনো রণাঙ্গনে অফুরন্ত শক্তির উৎস হয়ে দেখা দেয়। যোদ্ধারা হয়ে উঠেন আরও বেশি নিঃস্বার্থ, বুঝতে পারেন তাদের নেতা বা কমান্ডার কেবল অধীনস্থদেরকেই সামনে ঠেলে দেননি, নিজেও জীবন দিয়েছেন।

সোলাইমানির মতো কমান্ডারেরা বিনয়েরও পরম শিক্ষা দিয়ে যান, সব সৈনিকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নিজেকে সৈনিক হিসেবে পরিচয় দিতে সম্মানিতবোধ করেন। সোলাইমানির কবরের পাথরখণ্ডে সৈনিক শব্দের সঙ্গে ‘বেলায়েত’ শব্দটি যোগ করে তা খোদাই করেছিলেন কবরস্থান কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তার পরিবারের সদস্যরা তা মেনে নেননি। কারণ তিনি ওসিয়তনামায় স্পষ্টভাবে বলেছেন, নামের আগে শুধু সৈনিক লিখতে হবে, অন্য কোনো পদবী নয়। অবশেষে তাই হয়েছে। সোলাইমানির কবরে লেখা হয়েছে ‘সৈনিক কাসেম সোলাইমানি’। ওসিয়ত অনুযায়ী তার এক সময়ের অধীনস্থ ইউসুফ এলাহির পাশেই শায়িত আছেন সোলাইমানি। তাঁর সান্নিধ্যে শহীদ ইউসুফ এলাহিও এখন ইরানে এক পরিচিত নাম। ইউসুফ এলাহির পবিত্র আনুগত্য ও আত্মত্যাগের প্রতিদান হয়তো এভাবেই দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এই বীর সেনানী। সূত্র: পার্সটুডে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, রেডিও তেহরান।