- Bangladesher Shomoy | বাংলাদেশের সময়.কম - https://www.bangladeshershomoy.com -

চীন থেকে চলে যাচ্ছে বিদেশি কারখানা, বাংলাদেশ সুযোগটা নেবে?

করোনাভাইরাসের দ্বারা সৃষ্ট ব্যাধি ‘কভিড-১৯’-এর প্রকোপে বিশ্বময় শিল্প-বাণিজ্য যে প্রচন্ড ধাক্কা খায়, সেই ‘তিক্ত অভিজ্ঞতা’র আলোকে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ তাদের কারখানাগুলো চীন থেকে সরিয়ে নিতে চাইছে। সরিয়ে নিয়ে এসব উৎপাদন ইউনিটকে বসানো হবে অন্যকোন দেশে। সুযোগটা কাজে লাগাতে খুবই সচেষ্ট ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া এবং আরও কিছু দেশ। প্রশ্ন উঠেছে, চীনত্যাগী কারখানাগুলোকে নিজ ভূখন্ডে পাওয়ার সুযোগ কী বাংলাদেশ কাজে লাগাবে?

পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, কিছুদিনের মধ্যেই অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থজনিত আন্তর্জাতিক টানাপোড়েনের কারণে চীন থেকে বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাহারের হিড়িক পড়ে যাবে। এই বিনিয়োগ তেমন দেশেই যাবে, যে দেশকে সে ‘নির্বিঘ্ন ফলদায়ক’ ভাববে। তাই, বিভিন্ন দেশ এই বিনিয়োগ আকর্ষণে বহুবিধ ইতিবাচক পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কী করছে?

সূত্র জানায়, বিনিয়োগ বিকাশে নিবেদিত বাংলাদেশের দুটি সংস্থা তাদের তৎপরতা ‘চীন পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণের গুরুত্ব’ বর্ণনা করে সরকারের সঙ্গে চিঠি চালাচালির মধ্যে সীমিত রেখেছে। সংস্থা দু’টি হল : বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন্স অথরিটি (বেজা) ও বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা)।
ভারতের ছুটোছুটি : চীন থেকে গুটিয়ে নেওয়া কারখানা যাতে তার মাটিতে এনে বসানো হয়, সেজন্য ভারত এপ্রিল মাস থেকেই বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীদের কাছে ধর্ণা দিয়ে চলেছে। জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সহস্রাধিক কোম্পানির কাছে গিয়ে ভারত বলছে, ‘এসো বিনিয়োগ কর। প্রয়োজনীয় সব রকম সুবিধা তোমাদের দেব’। ভূমি আইন, শ্রম ও কর আইনও ভারত ঢেলে সাজাতে চলেছে বিদেশি বিনিয়োগের সুবিধার্থে।

জাপানি কোম্পানিগুলোকে প্রভাবিত করছে নয়াদিল্লি। একই পন্থা অনুসরণ করছে ভিয়েতনাম। পশ্চিমা পত্র-পত্রিকা জানায়, এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি ভারত প্রচুর জমি আলাদা করে রেখেছে যেখানে চীনত্যাগী বিদেশি কারখানাগুলো এসে উৎপাদন করবে। নয়াদিল্লি এজন্য কিছু মার্কিন ও জাপানি কোম্পানিকে টার্গেট করেছে যারা উৎপাদন করে থাকে মেডিকেল সরঞ্জাম, প্রক্রিয়াজাত খাবার, কাপড় আর অটোপার্টস। ভিয়েতনামের সুবিধা : উৎপাদন নৈপুণ্য আর পণ্যমান রক্ষায় একনিষ্ঠতার পরিচয় দেওয়ায় ভিয়েতনাম ইতিমধ্যে ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ (চীনে যা পাওয়া যায়, এরাও তা দিতে সক্ষম) বলে অভিহিত হতে শুরু করেছে। চীন ছাড়তে উদ্যত কারখানাগুলোর কাছে নতুন জায়গায় বসবার জন্য ‘অতি উত্তম’ ভিয়েতনাম।

চীনের অদূরে অবস্থিত হওয়ায় ভিয়েতনামে যন্ত্রপাতি স্থানান্তরে ব্যয় হবে কম। তাছাড়া, এদেশে আগে থেকেই ব্যবসাবাণিজ্য করছে আন্তর্জাতিকভাবে সুখ্যাত অনেক কোম্পানি। সবচেয়ে বড় কথা। কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে দ্রুত সাফল্য দেখিয়ে ভিয়েতনাম বিশ্বের প্রশংসা পেয়েছে। এই বিষয়গুলো বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মনে দৃঢ় আস্থা তৈরির সহায়ক হয়েছে। গলদ যেখানে : সরবরাহ প্রবাহ বা সাপ্লাই চেইন অবাধ হওয়ার ওপর নির্ভর করেই সচল থাকে ‘উৎপাদন-ব্যবস্থার প্রাণ। করোনাকালে এই প্রাণ হাঁসফাস করেছে অনেক দেশে। কারণ, তারা তাদের কারখানার কাঁচামালের জন্য শুধুমাত্র চীনে উৎপাদিত সামগ্রীর ওপর নির্ভর করে। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর চায়নিজ অ্যান্ড অ্যামেরিকান স্ট্যাডিজের আন্তর্জাতিক রাজনীতির অধ্যাপক ড. ডেভিড অ্যারেস মনে করেন, কোভিড-১৯-এর ছোবল উন্নত-অনুন্নত সব দেশেরই (যারা চীনা দ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল) চোখ খুলে দিয়েছে। চোখ খুলে দেয় তাদেরও যারা চীনের মাটিতে বিনিয়োগ খাটিয়ে উৎপাদন করেছে এতদিন। লকডাউন আর শাটডাউন কবলিত ওসব কারখানায় উৎপাদিত পণ্য তারা ‘নিজ দেশে’ আনতে পারছে না।

এ ধরনের সংকট সামনের দিনগুলোয় আরও তীব্র হওয়ার আশংকা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই সাবধানী পদক্ষেপ পর্যায়ে চীন থেকে কারখানা অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানী কোম্পানিগুলো। এমনকি কোরীয় কোম্পানিগুলোও চীন থেকে সরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে।

জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে তাঁর দেশের কোম্পানিগুলোর উৎপাদন ইউনিট চীনের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য ইতিমধ্যে ২২০ কোাটি ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। ড. ডেভিড অ্যারেস বলেন, সাপ্লাই চেইন বিষয়ে চীনের ওপর নির্ভরতা কমানোর উদ্যোগের পেছনে দু’টি কারণ রয়েছে। প্রথম কারন হল, বহু জাপানি ফার্ম ‘চীন উতলা।’ এরা অতিগুরুত্বপূর্ণ পণ্যের জন্য একান্তভাবে চীনা ফ্যাক্টরি ও ফার্মগুলোর ওপর নির্ভরশীল। কোভিড-১৯ দেখিয়েছে, এই অতি-নির্ভরতার দরুন জাপানের বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক সরবরাহ ধারা (সাপ্লাই চেইন) ঝুঁকিগ্রস্ত হয়েছে। বিঘিœত হয়েছে সেসব পণ্যের সরবরাহ যেগুলো জাপানের সুস্থিতি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এক ঢিলে দুই পাখি : দ্বিতীয় কারণ হল কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ জাপানি পণ্যের উৎপাদন ব্যবস্থাকে ‘শুধু চীন নয়’ অবস্থায় স্থাপন। ড. ডেভিড অ্যারেস বলেন, এতে জাপান এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করতে সক্ষম হবে। একদিকে জোরদার হবে জাতীয় নিরাপত্তা। অন্যদিকে উপকৃত হবে জাপানের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ফার্মগুলো যারা প্রদেশভিত্তিক টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনাকে এগিয়ে নেবে। এর প্রভাবে শিনজো আবের দল লিবারেল ডেমোক্রাটিক পার্টির রাজনৈতিক সুফলপ্রাপ্তির সম্ভাবনা তৈরি হবে।

বোধ ও বাস্তবতা : বেজা বলছে, জাপানি শিল্প-কারখানার ‘রিলোকেশন ডেস্টিনেশন’ হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে সুস্পষ্ট ও ফলপ্রসূ কিছু প্রস্তাব দিতে হবে। শুধু কি তা-ই? বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, চাপের মধ্যে রাখার বদলে ব্যবসা বাণিজ্য সহায়ক হওয়ার জন্য আমলাতন্ত্রের সামগ্রিক মনমানসিকতা বদলাতে হবে। দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার জন্য কাজ করছে বেজা। এর মধ্যে ৩টি নির্দিষ্ট করা আছে জাপান, ভারত ও চীনের জন্য যাতে তারা বাংলাদেশে তাদের পণ্য উৎপাদন ইউনিট সহজে স্থাপন করতে পারে। শতভাগ রপ্তানিমুখী জাপানি বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ কিছু প্রণোদনা প্যাকেজ তৈরির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিচ্ছে বেজা। এ ব্যাপারে তারা যে সুপারিশমালা তৈরি করেছে সেগুলো অনুমোদনের জন্য সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠিয়েছে।

বর্তমানে বেজা রফতানি অঞ্চলের বিনিয়োগকারীদের ১০ বছরের ট্যাক্স হলিডে দেওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে। এর মধ্যে ৩ বছর সম্পূর্ণরূপে কর মওকুফ থাকবে। এই মেয়াদটি বাড়িয়ে ৭ বছর করার চিন্তাভাবনা করছে বেজা। মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে শত শত কোটি ডলারের বিনিয়োগ আনার লক্ষে বেজার যে প্রক্রিয়া তা করোনা মহামারি জনিত নজিরবিহীন বৈশ্বিক শাটডাউনের কারণে মন্থর হয়ে পড়বে। জানা গেছে, ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বেজা ১৫১টি দেশী ও বিদেশী প্রতিষ্ঠান থেকে ২৫০০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ইতিমধ্যে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ হয়েও গেছে। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, ভারত, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে আসবে প্রায় ৫৭৮ কোটি টাকার বিনিয়োগ। কোভিড-১৯ পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিনিয়োগচিত্রের অমূল পরিবর্তন ঘটবে। তাই বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে প্রতিটি দেশকে বিশেষ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম সম্প্রতি বলেছেন, বিদেশি বিনিয়োগ টানতে তারা প্যাকেজ প্রস্তাবনা তৈরি করছেন। তিনি বলেন, ‘বিডা শুধু সুপারিশমালা পেশ করতে পারে। জাপানের দু’টি সংস্থার সঙ্গে তিনি বিনিয়োগ সুবিধা নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। একটি ‘জাইকা’ অন্যটি জেটরো। পিডব্লিউসি (প্রাইসওয়াটারহাউস কুপার্স) বাংলাদেশ-এর ম্যানেজিং পার্টনার মামুন রশীদ বলেন, চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধের ফায়দা তুলতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এখন দ্বিতীয় সুযোগ এসেছে। সুযোগটা কী আমরা নেব না?

সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন