- Bangladesher Shomoy | বাংলাদেশের সময়.কম - https://www.bangladeshershomoy.com -

চলছেই মৃত্যুর মিছিল

মানব জীবনের অনিবার্য এক পরিণতির নাম মৃত্যু। সব মানুষই একই পথের যাত্রী। নিস্তার নেই কারোই। চলে যেতে হবে- এটাই নিয়ম। কিন্তু কখনো কখনো এ নিয়ম তৈরি করে বড় মর্মান্তিক দৃশ্যের। মানুষ তার ইতিহাসে মহামারী কম দেখেনি। কিন্তু করোনা যেভাবে সারা দুনিয়াকে অচল করে দিয়েছে তা অতীতে কখনো হয়নি। ক্ষুদ্র এক ভাইরাস তছনছ করে দিয়েছে সব।

চীনের উহানে যে মূর্তিমান আতঙ্কের সঙ্গে মানুষের প্রথম দেখা, আজ গ্রহ জুড়ে সেই আতঙ্ক করোনাভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধে লকডাউনে ঘরবন্দী নাগরিক। দেশে দেশে ঘরবন্দী মানুষ এখন ঘর থেকে বের হওয়ার লড়াই করছে। মিছিলে এরই মধ্যে যোগ হয়েছে চারলাখের বেশি নাম। আতঙ্ক, উদ্বেগ তাড়া করছে কোটি কোটি মানুষকে। কেউ জানেন না কখন তারা আক্রান্ত হবেন। কখন হারিয়ে ফেলবেন প্রিয় কোনো মুখ। বাংলাদেশের দৃশ্যপটও একই। তিন মাস আগে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা শনাক্ত হয়। সেই থেকে শুরু। প্রতিদিন কেউ না কেউ তাদের প্রিয়জন হারাচ্ছেন। গতকালই সর্বোচ্চ ৪২ জনের মৃত্যুর রেকর্ড হয়েছে। সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত করোনায় মারা গেছেন ৮৮৮জন। আক্রান্তের সংখ্যা ৬৫ হাজার ছাড়িয়েছে। এছাড়া, করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যাও অসংখ্য। শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটেই ৩৫ দিনে ৪৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রবাসেও প্রায় ৮শ’ বাংলাদেশি করোনায় মত্যুবরণ করেছেন। পাহাড়ের মতো ভারি এসব মৃত্যু শোকাহত করেছে তাদের স্বজনদের, শোকাতুর করেছে পুরো জাতিকে। বিশেষ করে মৃতদেও শেষ বিদায়ের দৃশ্য সবচেয়ে মর্মান্তিক। মৃত্যুর সময়ও পিয় মানুষটির পাশে তাদের স্বজনদের কেউ থাকতে পারছেন না। আবার বহুক্ষেত্রে দাফনেও অংশ নিতে পারছেন না তারা। আবার কিছু কিছু জায়গায় দাফনে বাধা দেওয়ার মতো নিষ্ঠুর ঘটনাও ঘটেছে।

এই নিষ্ঠুরতার কারণেই সম্ভবত বহুক্ষেত্রে করোনায় মৃত ব্যক্তির নামও আমরা জানতে পারছি না। বিশেষ করে সাধারণ মানুষদের নাম, ছবি থেকে যাচ্ছে দৃশ্যপটের বাইরে। করোনায় আমরা হারিয়েছি জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানকে। যদিও তিনি আরও নানা ধরনের রোগে ভুগছিলেন। মৃত্যুর পরই জানা যায়, তিনি করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। করোনায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন ফ্রন্টলাইন যোদ্ধারা। শুরুতে চিকিৎসকদের আক্রান্তের হার ছিল বেশি। এ পর্যন্ত অন্তত ১৮ জন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন আরো দুজন চিকিৎসক। এ পর্যন্ত পুলিশের ১৮ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। করোনায় মৃত সাধারণ মানুষের দাফনের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করছে পুলিশ বাহিনী। করোনায় একজন সাংবাদিকের মৃত্যু হয়েছে। আর উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন আরও চার সংবাদকর্মী। করোনায় মৃতের তালিকায় রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য মকবুল হোসেন, এস আলম গ্রুপের পরিচালক মোরশেদ আলম, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান ইমামুল কবির শান্ত। আরও অনেক বিশিষ্টজন রয়েছেন এ তালিকায়। গতকালও মৃত্যুর মিছিলে চিকিৎসক, ব্যাংকার, শিল্পপতি এবং সাংবাদিকসহ ৪২ জনের নাম হয়েছে।
ডা. মির্জা নাজিমুদ্দিন : ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউর বিভাগীয় প্রধান ও ওই হাসপাতালে পরিচালক (মেডিকেল সার্ভিস) ডা. মীজা নাজিমউদ্দীন। গতকাল রবিবার বিকালে তিনি মারা যান। তিনি করোনা পজিটিভ হলে স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে গত একমাস ধরে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাকে প্লাজমা থেরাপিসহ উন্নত বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিভিন্ন চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। এই চিকিৎসককে নিয়ে দেশে এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মোট ২৩ জন চিকিৎসকের মৃত্যু হলো। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডাক্তার মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও মহাসচিব অধ্যাপক ডাক্তার এহতেশামুল হক চৌধুরী এক শোক বিবৃতিতে এই তথ্য জানিয়ে শোকসন্তপ্ত প্রত্যেক চিকিৎসকের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেছেন।

শিল্পপতি আজমত মঈন : করোনা সংক্রমণে মারা গেলেন বিশিষ্ট শিল্পপতি আজমত মঈন (ইন্নালিল্লাহি… রাজিউন)। শনিবার দিবাগত রাতে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে মারা যান তিনি। দেশের চা-শিল্পের খ্যাতিমান ব্যবসায়ী ছিলেন আজমত মঈন। তিনি মৌলভী চা- কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান, সুরমা চা- কোম্পানির পরিচালক ছিলেন ও অভিব্যক্ত বাংলার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী নবাব মোশারফ হোসেনের প্রপৌত্র। তার বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। কয়েকদিন আগে বার্ধক্যজনিত কারণে ইন্তেকাল করেছেন আজমত মঈনের বাবা গোলাম মঈন।

করোনায় ১৫ ব্যাংকারের মৃত্যু : মহামারী করোনাভাইরাসে (কভিড-১৯) আক্রান্ত হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা মারা গেছেন। তার নাম আমিরুল আজিজ। মৃত্যুর আগে তিনি ব্যাংকটির বান্দরবান জেলার আলীকদম শাখায় কর্মরত ছিলেন। রবিবার ব্যাংকটির গণসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেন। জানা গেছে, গতকাল শনিবার চট্টগ্র্রাম জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমিরুল আজিজ মারা যান। তার স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ পর্যন্ত প্রাণঘাতী এ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন দুই শতাধিক ব্যাংককর্মী। কৃষি ব্যাংকের এ কর্মকর্তা আমিরুল আজিজসহ এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ১৫ জন ব্যাংকার। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের কর্মীরা। প্রাণঘাতী ভাইরাসে ব্যাংকটিতে এ পর্যন্ত ১০৩ জন আক্রান্ত হয়েছেন। প্রাণ গেছে তিনজনের। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যেখানে আক্রান্ত হয়েছেন অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা। সিনিয়র সাংবাদিক মোনায়েম কক্সবাজার শহরের তারাবনিয়ার ছরা কবরস্থান রোডের কানুনগো বদিউল আলমের জ্যেষ্ঠ ছেলে। সর্বশেষ তিনি ইংরেজি দৈনিক ডেইলি ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের কক্সবাজার জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি মারা যান করোনায়। আবদুল মোনায়েম খানের সঙ্গে থাকা তার সহধর্মিণীর ভাই জয়নাল আবেদীন জানান, কিছুদিন জ্বওে ভোগার পর গত ৩১ মে সাংবাদিক মোনায়েম ও তার সন্তান কক্সবাজার সিটি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র মোহাইমেন করোনাভাইরাস পজিটিভ হওয়ার রিপোর্ট আসে। শ্বাসকষ্ট দেখা দেওয়ায় ১ জুন রাতে মোনায়েমকে উখিয়া সারি আইসোলেসন অ্যান্ড ট্রিটমেন্ট সেন্টারে ভর্তি করা হয়। পরে চিকিৎসকদের পরামর্শে গত ৩ জুন তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে করোনা ওয়ার্ডেও রেড জোনে চিকিৎসাধীন ছিলেন সাংবাদিক মোনায়েম। রবিবার ভোরে তার অবস্থার অবনতি হলে কক্সবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আজম নাসিরের সহযোগিতায় দুপুর ২টার দিকে তাকে হাসপাতালের আইসিইউতে রাখা হয়। আইসিইউতে নেওয়ার পরপরই মোনায়েম খানের মৃত্যু হয়।

সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন