- Bangladesher Shomoy | বাংলাদেশের সময়.কম - https://www.bangladeshershomoy.com -

কোরআন-সুন্নাহর আলোকে সময়ের সদ্ব্যব্যাবহার: মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী

আল্লাহ মানবজাতিকে অসংখ্য-অগণিত নেয়ামত দান করেছেন, সেই নেয়ামতের অথৈ সাগরে আমরা ডুবে আছি। এই নেয়ামতের হিসাব করে কখনো শেষ করা যাবে না, বান্দা এই নেয়ামতের কতটুকু শুকরিয়া আদায় করে এ বিষয়টি চিন্তার বিষয়।

এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা আর-রহমানে অসংখ্যবার ইরশাদ করেছেন তোমরা তোমাদের রবের কোন্ কোন্ নেয়ামতকে অস্বীকার করবে অপর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন যদি তোমরা আল্লাহর নেয়ামত গণনা কর. তবে গুনে শেষ করতে পারবে না (সূরা, ইব্রাহিম-৩৪) আল্লাহপাক আমাদের যে সমস্ত নেয়ামত দান করেছেন, তার মাঝে সময় হচ্ছে অন্যতম একটি নেয়ামত, এই নেয়ামতের গুরুত্ব অনেক বেশি।

পৃথিবীর শুরুর লগ্ন থেকেই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন, চন্দ্র, সূর্য, আকাশ, বাতাস, গ্রহ, নক্ষত্র, সব কিছুকে একটি নির্দিষ্ট সময়ে পরিচালনা করে আসছেন। সূর্য প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে উদিত হয়, আবার নির্দিষ্ট সময়ে অস্ত যায়, আল্লাহ পবিত্র কোরআনের একাধিক জায়গায় দিবারাত্রির কসম খেয়েছেন। কোথাও দিনের কসম, কোথাও রাতের কসম, কোথাও সকালের, আবার কোথাও সময়ের কসম খেয়েছেন। যার দ্বারা সময়ের গুরুত্ব খুব সহজেই বোঝা যায়। এছাড়া শরিয়তের হুকুম আহকামের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ইসলামের প্রতিটি ইবাদতের জন্য আল্লাহ একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। হজ যেমন নির্দিষ্ট সময় পালন করার জন্য নির্ধারণ করেছেন, জাকাত নির্দিষ্ট পরিমাণ মাল হলে নির্দিষ্ট সময়ে আদায় করার জন্য নির্ধারণ করেছেন, ফরজ নামাজের জন্যও একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করেছেন।
এভাবে শরিয়তের আরও অন্যান্য হুকুম-আহকামের মাঝে সময়ের মালা গাঁথা রয়েছে। নামাজের ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, নিশ্চয়ই নামাজ মুসলমানদের ওপর ফরজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (সূরা নিসা-১০৩) হাদিস শরিফেও এ ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহ আলাইহে ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম, কোন আমল আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়? তিনি উত্তরে বললেন, যথাসময়ে আদায় কৃত নামাজ। (বুখারি, মুসলিম, তিরমিযি, নাসায়ী)। ওই আয়াত ও হাদিস দ্বারা বোঝা গেল সময়ের গুরুত্ব অপরিসীম, তাই সময়ের কদর করতে হবে, সময়কে মূল্যায়ন করতে হবে, সময়ের সদ্ব্যবহার করতে হবে, হেলায় খেলায় সময়কে নষ্ট করা যাবে না। সময় এমন এক মূল্যবান সম্পদ ও এমন একটি রত্ম, যা একবার চলে গেলে আর কখনই ফিরে আসবে না। সময় হলো নদীর স্রোতের ন্যায়, নদীর স্রোত যেভাবে বয়ে চলে নিরবধি, যা একবার বয়ে চললে আর কখনো ফিরে আসে না, ঠিক সময়ও এরকম, যা একবার হারিয়ে গেলে আর ফিরে আসে না, ধন সম্পদ তো হারিয়ে গেলে তা আবার ফিরে পাওয়ার আশা থাকে, কিন্তু সময় যদি হারিয়ে যায় তা আর দ্বিতীয়বার ফিরে আসে না।

সুতরাং বুঝা গেল ধন-সম্পদ থেকেও সময় অতি মূল্যবান। এভাবেই সময় তার নিজ গতিতে চলতে থাকে, সব কিছু শুরু হয়, আবার শেষ হয়, রাত যায় দিন আসে, দিন যায় রাত আসে, শেষ হয়ে যায় সপ্তাহ, পক্ষ, মাস ও বছর। এভাবেই চলতে থাকে আমাদের জীবন প্রহর। সময়ই মানুষের জীবন, আরবিতে একটি প্রবাদ বাক্য আছে, সময়ের নামই তো জীবন, তাকে নষ্ট কর না। সময়ের সদ্ব্যবহার দ্বারা যেমন ব্যক্তি সফলতার উচ্চ মাকামে পৌঁছে। অপরদিকে এর অবহেলার দ্বারা সে নিক্ষিপ্ত হয় ব্যর্থতার অতল গহ্বরে। সময়কে যারা মূল্যায়ন করে, তারাই সফলকাম হয়, তাদের ভবিষ্যৎ হয় উজ্জ্বল, আর যারা সময়ের মূল্য সম্পর্কে বুঝে না, তাদের জীবনের সফলতা আসে না। আসে শুধু ব্যর্থতা আর পদস্খলনতা। আল্লাহ আমাদের এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন স্বল্প হায়াত দিয়ে, দুনিয়াতে আমাদের সময় খুব কম, কিন্তু মানবজীবনে পালনীয় কর্তব্য অনেক বেশি, অল্প সময়ে অপরিসীম কাজ আঞ্জাম দেওয়ার হেকমত হলো, সময়ের হেফাজত করা, সীমিত হায়াতে সময় নষ্ট না করে, অপরিসীম দায়িত্ব যে পালন করা সম্ভব, তার দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছেন আমাদের পূর্বসূরিরা, আমাদের পূর্বসূরিদের জীবনের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, উনারা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সময়কে গুরুত্ব দিয়েছেন, সময়কে কাজে লাগানোর মাঝেই তারা নিমজ্জিত ছিলেন।

সময়কে মূল্যায়ন করে যারা বড় হয়েছেন তাদের কয়েকটি ঘটনা নিম্নরূপ : ১. ইমাম আবু ইউসুফ রহ: যখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত, জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত, তখনো তিনি ফিকহি একটি মাসআলা নিয়ে চিন্তারত ছিলেন। ২. হজরত দাউদ তায়ী রহ: রুটির পরিবর্তে ছাতু খেতেন, কারণ জিজ্ঞাসা করার পর তিনি বললেন, রুটির পরিবর্তে ছাতু খেলে ৫০ আয়াত বেশি তেলওয়াত করা যায়। ৩. বিখ্যাত নাহুবিদ খলিল ইবনে আহমাদ রহ: বলতেন, আমার কাছে সবচেয়ে অসহ্যকর লাগে ওই সময়টুকু যখন আমি খাওয়া-দাওয়া করি। (সাফহাতুম মিন সাবরিল উলামা)। এভাবে আরও অনেক অসংখ্য অগণিত আকাবিরগণ রয়েছেন যাদের কাছে সময়ের মূল্য ছিল অপরিসীম, যার কারণে তাঁরা হতে পেরেছেন যুগশ্রেষ্ঠ আলেমেদ্বীন। তারা যেভাবে সময়কে মূল্যায়ন করে বড় হতে পেরেছেন, হতে পেরেছেন বিশিষ্ট আলেম, যুগ শ্রেষ্ঠ বুজুর্গ ও আল্লাহর ওলি, আমরা চেষ্টা করলে আমাদের পক্ষেও তাই হওয়া সম্ভব। হাদিস শরিফে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, পাঁচটি জিনিসের আগে অপর পাঁচটি জিনিসকে গুরুত্ব দাও (১) বৃদ্ধ হওয়ার পূর্বে যৌবনকে (২) অসুস্থ হওয়ার আগে সুস্থকে (৩) দরিদ্র হওয়ার আগে স্বাবলম্বিতাকে (৪) ব্যস্ততার আগে অবসরতাকে (৫) মৃত্যুর আগে জীবনকে (ইবনে আবি শাইবা ৩৫৪৬০)

লেখক: মুহাদ্দিস, মুফাসসির, খতিব ও টিভির ইসলামী অনুষ্ঠান উপস্থাপক।