- Bangladesher Shomoy | বাংলাদেশের সময়.কম - https://www.bangladeshershomoy.com -

ঈদুল আযহা ও কুরবানীর শিক্ষা

ঈদুল আযহা মুসলমানদের সবচেয়ে বড় দুটি ধর্মীয় উৎসবর অন্যতম একটি। ঈদ ও আযহা দুটিই আরবী শব্দ। ঈদ এর অর্থ উৎসব বা আনন্দ। আযহার অর্থ কুরবানী বা উৎসর্গ করা। হযরত ইবরাহীম (আ.) আল্লাহ তা’লার আদেশ পালনের উদ্দেশ্যে প্রাণপ্রিয় জ্যেষ্ঠ পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.)-কে তাঁর পূর্ণ সম্মতিতে কুরবানী করতে উদ্যত হন । মক্কার নিকটস্থ ‘‘মীনা’’ নামক স্থানে এ মহান কুরবানীর উদ্যোগ নেওয়া হয়। তাঁর ঐকান্তিক নিষ্ঠায় সন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহ তায়ালা হযরত ইবরাহীম (আ.)-কে তাঁর পুত্রের স্থলে একটি পশু কুরবানী করতে আদেশ দেন। আল্লাহর প্রতি অবিচল আনুগত্য ও নজিরবিহীন নিষ্ঠার এ মহান ঘটনা অনুক্রমে আজও মীনায় এবং মুসলিম জগতের সর্বত্র আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে পশু কুরবানীর রীতি প্রচলিত রয়েছে।

উৎসর্গকৃত পশু, যা’ এক আল্লাহর উদ্দেশ্যে যবেহ করা হয়, আত্মীয়-স্বজন বিশেষত দুঃস্থ দরিদ্রজনের মধ্যে যা’ বিতরণ করে আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক তাঁর সান্নিধ্য লাভ করার চেষ্টা চালান হয়, সে সার্থক প্রচেষ্টার যে আত্মিক আনন্দ তাই ঈদুল আযহা নামে অভিহিত হয়। এ দিনে মীনায় হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর অনুপম কুরবানীর অনুসরণে কেবল হাজীদের জন্য নয়, বরং মুসলিম জগতের সর্বত্র সকল সক্ষম মুসলমানদের জন্য এ কুরবানী করা ওয়াজিব, মতান্তরে সুন্নাতে মুআক্কাদা।

ঈদুল আযহা ১০ই যু’ল-হিজ্জা, যে দিন পবিত্র হজ্জব্রত পালনকালে হাজীরা মীনা প্রান্তরে কুরবানী করেন এবং তৎপরবর্তী দুই দিনে, মতান্তরে তিন দিনও (আয়্যাম-আল-তাশরীকে) অনুষ্ঠিত হয়।

এ দিনটিতে মুসলমানেরা প্রথমে ফযরের নামাযের পর ঈদগাহে গিয়ে ছয় তাকবীরের সহিত দুই রাক্বাত ঈদুল আযহার নামাজ আদায় করতে হবে আর এই নামায আদায় করা ওয়াজিব। নামাযের পর খুতবা প্রদান করা সুন্নাত এবং মুসল্লীদের খুতবা শুনা ওয়াজিব। নামায শেষ করে অব্যবহিত পরে স্ব-স্ব আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ ও উট আল্লাহর নামে কোরবানি করে।

*হাদীসের বর্ণনা, হযরত বারা’আ (রাঃ)থেকে ববর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করিম(সঃ) -কে খুত্‌বা দিতে শুনেছি। তিনি বলেছেনঃ আমাদের আজকের এ দিনে আমরা যে কাজ প্রথম শুরু করব, তা হল সালাত আদায় করা। অতঃপর ফিরে আসব এবং কুরবাণী করব। তাই যে এ রকম করে সে আমাদের রীতি সঠিকভাবে মান্য করল।(সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৯৫১)

★গুরুত্ব :

ঈদুল আযহার গুরুত্ব অপরিসীম। কুরআন-হাদীছে এ ব্যাপারে যথেষ্ট তাকীদ দেওয়া হয়েছে।
*মহান আল্লাহ বলেন, وَالْبُدْنَ جَعَلْنَاهَا لَكُم مِّنْ شَعَائِرِ اللهِ لَكُمْ فِيْهَا خَيْرٌ-
‘আর কুরবানীর পশু সমূহকে আমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে’ (হজ্জ ৩৬)

*আল্লাহ আরও বলেন, وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيْمٍ- وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِيْنَ-
আর আমরা তাঁর (ইসমাঈলের) পরিবর্তে যবহ করার জন্য দিলাম একটি মহান কুরবানী। আমরা এটিকে পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিলাম’ (ছাফফাত ১০৭-১০৮)।

*আল্লাহ বলেন, فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ
‘তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে ছালাত আদায় কর এবং কুরবানী কর’ (কাওছার ২)

*কাফির-মুশরিকরা তাদের দেব-দেবী ও বিভিন্ন কবর ও বেদীতে পূজা দেয় এবং মূর্তির উদ্দেশ্যে কুরবানী করে থাকে। তার প্রতিবাদ স্বরূপ মুসলমানকে আল্লাহর জন্য ছালাত আদায়ের ও তাঁর উদ্দেশ্যে কুরবানী করার হুকুম দেওয়া হয়েছে।

*আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ كَانَ لَهُ سَعَةً وَلَمْ يُضَحِّ فَلاَ يَقْرِبَنَّ مُصَلاَّنَا
‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়’। বুখারী

*এটি ইসলামের একটি ‘মহান নিদর্শন’ যা ‘সুন্নাতে ইবরাহীম’ হিসাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে মদীনায় প্রতি বছর আদায় করেছেন এবং ছাহাবীগণও নিয়মিতভাবে কুরবানী করেছেন। অতঃপর অবিরত ধারায় মুসলিম উম্মাহ্র সামর্থ্যবানদের মধ্যে এটি চালু আছে। এটি কিতাব ও সুন্নাহ এবং ইজমায়ে উম্মত দ্বারা সুপ্রমাণিত।

★কুরবানীর শিক্ষাঃ

বর্তমান মুসলিম সমাজে চালুকৃত কুরবানি মূলত হযরত ইবরাহীম আলাইহি সালাম ও তাঁর পরিবারের চরম আত্মত্যাগের স্মরণ হিসেবেই চলে আসছে।

কুরবানি ইতিহাস কারোই অজানা নয়। একবার নিজেকে প্রশ্ন করি, কেন আল্লাহ তায়ালা ইবরাহিম আ. কে নিজ সন্তানকে আল্লাহর নামে কুরবানি করার হুকুম দিলেন? আবার কেনই বা ইসমাঈল আলাইহি সালাম-এর পরিবর্তে বেহেশত থেকে দুম্বা এনে তা জবেহ করালেন? উত্তরটা সহজ।

প্রথমত, দুনিয়ার নিয়মে যেমন সনদ দেয়ার আগে পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যতা যাচাই করে নেওয়া হয়, তেমনি খলিলুল্লাহ বা আল্লাহর বন্ধু উপাধি দেওয়ার আগে আল্লাহ হযরত ইবরাহিম আ.এর ও একটা কঠিন পরীক্ষা নিলেন।

আর পুত্রের বদলে দুম্বা কুরবানি করিয়ে আল্লাহ তার পরবর্তী বান্দাদেরও এই বিশাল পরীক্ষায় অংশগ্রহনের সাওয়াব দান ও রাহে খলিলুল্লাহ-এ চলার আসান ব্যবস্থা করে দিলেন। সুতরাং, কুরবানির তাৎপর্য বর্ণনা করতে আর শব্দ খরচ করার প্রয়োজন পড়ে না।

আল্লাহ পাক বলেন,এগুলোর রক্ত ও গোশত আল্লাহর কাছে পৌছে না, পৌছে তোমাদের তাকওয়া। (সূরা হজ্জ-৩৭)

আল্লাহ সামর্থ্যবান মুসলমানদের ওপর কুরবানি ওয়াজিব করেছেন। তবে আমরা যদি কুরবানি বলতে শুধু পশু-জবাই বুঝি, তাহলে ভুল করবো। কুরবানি শুধুই পশু জবাই নয়। ইসলামের অন্যান্য ইবাদতের মত কুরবানির মধ্যেও রয়েছে অনেক শিক্ষা। ফলে যেমন আমরা পশু-কুরবানি করার প্রতি গুরুত্ব দেই, তেমনি আমাদের কোরবানির শিক্ষার প্রতিও মনোযোগ দিতে হবে।

কুরবানির নানা শিক্ষা ও তাৎপর্য রয়েছে, আমরা কোরআনের উল্লিখিত দুই আয়াতের আলোকে সংক্ষিপ্ত আলোকপাতের চেষ্টা করবো।

১. কুরবানি আমাদের ত্যাগ ও উৎসর্গ শিক্ষা দেয়। আমাদের উপর ইসলামের যে বিধানই আবশ্যক হোক, আমাদের পালন করতে হবে। আল্লাহর রাজি-খুশির জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালাতে হবে।

২. কুরবানি আমাদেরকে তাকওয়ার শিক্ষা দেয়ঃ কুরবানীর মাধ্যমে মুমিনরা তাকওয়ার শিক্ষা পায়। কেননা আল্লাহর দরবারে গোস্ত বা রক্ত পৌছে নাহ বরং মনের তাকওয়াটা আল্লাহ দেখেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,আল্লাহ তায়ালার নিকট তোমাদের রক্ত ও গোস্ত পৌছে নাহ বরং মনের তাকওয়া পৌছায়।(সুরা হজ্ব-৩৭)

৩. কুরবানি আমাদেরকে সাম্য,সামাজিকতা ও আলাপ-আলোচনা করতে শিক্ষা দেয়। আসলে আমরা যেমন বলেছি, ইসলাম ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তো, ইসলাম কীভাবে সমাজ পরিচালনা করতে চায়? সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে ইসলাম সাম্য, সামাজিকতা ও আলাপ-আলোচনার গুরুত্ব দেয়।

৪. ধৈর্য শিক্ষা দেয়ঃ দুনিয়ার সামান্য জীবনের বিনিময়ে আখিরাতে অনন্তকালের জান্নাতি সুখ অবশ্যই ত্যাগ ও কুরবানির বিনিময়েই অর্জন করতে হবে। বান্দাহর পরীক্ষা গ্রহণ আল্লাহর এক স্থায়ী নিয়ম। তাঁর ভাষায় ‘আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে ভয়-ভীতি, অনশন, জানমালের ক্ষতি ও আমদানি হ্রাসের দ্বারা পরীক্ষা করবো।

যেমন আল্লাহ বলেছেন,বিপদ-মুছিবত উপস্থিত হলে যারা ধৈর্য ধারণ করে ও বলে যে, আমরা আল্লাহরই জন্য এবং তাঁর কাছেই ফিরে যাব। তাদের জন্য সুসংবাদ’ (বাকারা ১৫৫-১৫৬)

৫. আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমার্পণঃকুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমার্পণ করার শিক্ষা দেই। যেমন সূরা আন-আমের ১৬২নং আয়াতে আল্লাহ ইরশাদ করেন,‘বলুন (হে নবি সা., আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু শুধুমাত্র বিশ্ব জগতের প্রতিপালক মহান রব্বুল আলামিনের জন্যেই।’

৬. তাকওয়াভিত্তিক জীবন-যাপন: কুরবানীর সুমহান দীক্ষা তাকওয়াভিত্তিক জীবন-যাপন। জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জনই মুমিনের প্রকৃত সফলতা। বস্তুত আল্লাহ তায়ালা তার আমলকেই কবুল করেন, যার আমলে তাকওয়া বা খোদাভীতির সন্নিবেশন ঘটেছে। আদমপুত্র হাবিলের কুরবানী আল্লাহতায়ালা কবুল করেছিলেন তাকওয়ার প্রভাবের কারণেই।

৭. দরিদ্র ও অনাথের সুখে-দুঃখে অংশীদার: কুরবানীর অন্যতম শিক্ষা দরিদ্র ও অনাথের সুখ-দুঃখে ভাগীদার হওয়া। ঈদুল আযহার নামাজে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের সহাবস্থানের পাশাপাশি আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী ও দরিদ্র-অনাথের মাঝে কুরবানীর গোশত বণ্টন আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে, আমাদের সম্পদে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের অধিকার রয়েছে।

আমাদের প্রত্যেকের জীবনে এ শ্বাশত আয়াতের তাৎপর্য বাস্তবায়ন হোক, কুরবানির শিক্ষা আমাদের আলোকিত করুক। দুআ কবুলের জন্যে সর্বোত্তম এ মাসে এটা আমাদের দুআ, আমিন।