দীর্ঘ আট মাস পেরিয়ে গেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এরই এই যুদ্ধে মধ্যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ইউক্রেন। হাতছাড়া হয়েছে লুহানস্ক, ডোনেটস্ক, খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ চারটি অঞ্চল। যদিও এগুলো পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তবে এসব ভূখণ্ড রুশ ভূমির সঙ্গে রাখার তীব্র প্রচেষ্টা চালাচ্ছে রাশিয়া। ইতোমধ্যে খেরসনে বিপজ্জনক অভিযানের ঘোষণা দিয়েছে রুশ কর্তৃপক্ষ। এ লক্ষ্যে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বেসামরিক লোকজনকে।

এদিকে, দীর্ঘ এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে পাশে থেকে সহায়তা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপী ইউনিয়নের দেশগুলো। যুদ্ধে সহায়তা করতে গিয়ে অর্থনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে ইউরোপজুড়ে। বেসামাল হয়ে পড়েছে মূল্যস্ফীতি। এমতাবস্থায় ইউক্রেনের পাশ থেকে ইউরোপের সরে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ইউরোপে শুরু হয়েছে শীতকাল। যুদ্ধের কারণে ওই অঞ্চলে দেখা দিয়েছে জ্বালানিসংকট। হু হু করে বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। ফলে মূল্যস্ফীতি চরমে পৌঁছেছে। যুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হলে এই সংকট আরও ভয়াবহ রূপ নেবে। তখন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও বেসামাল হয়ে পড়বে। এমতাবস্থায় ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়া বন্ধ করতে পারে ইউরোপ- এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপ অনেকটাই রাশিয়ার জ্বালানিসম্পদের ওপর নির্ভরশীল। ফলে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার ওপর বিপুল নিষেধাজ্ঞা জারি সত্ত্বেও দেশটিকে দমন করা যায়নি। আর ইউরোপের এই জ্বালানি নির্ভরতার কারণেই ইউরোপের যেসব দেশ ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে, দেশগুলোকে ধরাশায়ী করতে জ্বালানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে মস্কো।

যদিও ইউরোপের ওই দেশগুলোও বসে নেই। রাশিয়া থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি বন্ধ করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে তারা। এখন তাদের অগ্রাধিকারের শীর্ষে রয়েছে রাশিয়ার তেল–গ্যাসের বিকল্প কোনও উৎস খোঁজা। শুধু তাই নয়, চলতি শীতে সংকট মোকাবিলায় জ্বালানি সাশ্রয়েও কৌশলও অবলম্বন করছে ইউরোপের দেশগুলো।

ইতোমধ্যে সংকট মোকাবিলায় বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে জার্মানি। চেকোস্লোভাকিয়ায় সরকারি অফিসগুলোতে পুরোনো বাল্ব সরিয়ে বিদ্যুৎ–সাশ্রয়ী এলইডি বাল্ব ব্যবহার করা হচ্ছে। ইতালিতে ঘরের ভেতরের তাপমাত্রা ১৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে বলা হয়েছে, কম তাপে খাবার রান্না করতে। ইউরোপের নামীদামি নানা ব্র্যান্ডের দোকানগুলোতে সময়ের আগেই বৈদ্যুতিক বাতি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে চলতি নভেম্বরে ৮০ শতাংশ গ্যাস মজুত করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল ইউরোপের দেশগুলো। সেই লক্ষ্যও পূরণ হয়েছে। অনেক দেশ ৮০ শতাংশেরও বেশি গ্যাস মজুত করেছে। এরপরও সামনের কঠিন শীতের মাসগুলোতে ইউরোপ ইউক্রেনের পাশে থাকবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

কেননা, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, “আমাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে আমরা কিছুই সরবরাহ করব না। গ্যাস, কয়লা, তেল—কিছুই না।” সুতরাং যুদ্ধে ইউক্রেনকে সহায়তা করে রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি সহায়তার আশা করা অবাস্তব।

অন্যদিকে, ইউরোপের দেশগুলোর হাতে মজুত থাকার পরও তাদের রাশিয়া থেকে পাইপলাইনে করে আসা গ্যাসের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মনে করেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিরাপত্তাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ রাফায়েল লস। আল–জাজিরাকে তিনি বলেন, যদি রাশিয়া থেকে গ্যাস সরবরাহে বাধা আসে, তাহলে ইউরোপের দেশগুলোর বাসাবাড়ি ও শিল্পকারখানায় এর প্রভাব পড়বে।

তাছাড়া উত্তর আমেরিকা, উপসাগরীয় দেশগুলো ও নরওয়ে থেকে আসা জ্বালানি রাশিয়ার জ্বালানির বিকল্প হিসেবে পুরোপুরি চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ রাফায়েল লস বলেন, এমন পরিস্থিতিতে পুতিন আশা করছেন, শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে ইউক্রেনের বিপুল পরিমাণ বাসিন্দা আশপাশের দেশগুলোতে পাড়ি জমাবেন।

তিনি আরও বলেন, পুতিন যদি চলমান ‘জ্বালানিযুদ্ধ’ কাজে লাগিয়ে ইউরোপের দেশগুলোতে জনবিক্ষোভ শুরু করাতে পারেন; অভিবাসনসংকট জোরদার করতে পারেন এবং ভুয়া তথ্য ছড়ানোয় সফল হন, তাহলে এর প্রভাবে ইউক্রেনে ইউরোপের দেশগুলোর সহায়তার হার কমে যেতে পারে। আর পুতিন এটাই চাইছেন। আর এক্ষেত্রে পুতিন সফল হলে ইউক্রেনের পাশ থেকে সরে দাঁড়াতে পারে ইউরোপের দেশগুলো।