- Bangladesher Shomoy | বাংলাদেশের সময়.কম - https://www.bangladeshershomoy.com -

আজ কালের রোজনামচা

১। যুক্তরাজ্য থেকে দুটো খবর এসেছে, একটি খারাপ, একটি ভালো। খারাপটি হলো অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে করোনার টিকাটা বানানো চলছিল, সেটির ট্রায়ালে ভুল ডোজ দেওয়া হয়েছে। যদিও গবেষকরা বলছেন, এই ভুলটাকে ভিন্নভাবে সংশোধন করে ট্রায়ালের কাজ চালিয়ে যাওয়া হবে, তারপরও সংশয় জাগে। শেষ পর্যন্ত এই ভুল ডোজের কারণে পুরো টিকাটাই বাতিল হয়ে যাবে না তো! বাতিল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা কিন্তু আছে। কত লাখ কোটি টাকা আর কত দিন-রাতের পরিশ্রম পন্ড হবে, ভাবা যায়! দ্বিতীয় খবরটি ভালো, ভেন্টিলেটরে যে করোনা রোগীদের রাখা হয়, তাদের অধিকাংশই মারা যায়, কিন্তু ডেক্সামেথাসন নামের একটি স্টেরয়েড দিয়ে দেখা গেছে তাদের অনেকে বেঁচে যাচ্ছে। সুতরাং এই স্টেরয়েড ওষুধটিকে ভীষণভাবে করোনায় আক্রান্ত হওয়া মৃত্যুপথযাত্রীকে বাঁচানোর ওষুধ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, এটিই করোনা ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ জেতার হাতিয়ার। যে ওষুধই বিপদের সহায় হোক না কেন, করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গেলে করোনার টিকা ছাড়া আমাদের উপায় নেই। কিন্তু অতল সমুদ্রে যখন ডুবছি, হাতের কাছে বড় জাহাজ না হোক, ছোট একটি ডিঙি নৌকো তো পাওয়া গেছে।

২। ভারতের এক বলিউড তারকার আত্মহত্যা, দেশটিকে স্তব্ধ করে দিয়েছে কিছুক্ষণের জন্য। সুশান্ত সিং রাজপুত বেশকিছু ছবিতে চমৎকার অভিনয় করেছেন। নাম যশ খ্যাতি প্রতিপত্তি যখন দ্রুত বাড়ছিল, তখনই কিনা মানুষটি মাত্র ৩৪ বছর বয়সে নিজের জীবনের ইতি ঘটিয়ে দিলেন। চরম বিস্ময়কর ঘটনা তো বটেই। সুশান্ত অন্যান্য তারকার মতো ছিলেন না, বলিউডের তারকারা সাধারণত অল্প শিক্ষিত, প্রচন্ড ধর্মান্ধ এবং প্রচন্ড কুসংস্কারাচ্ছন্ন। সুশান্ত নিজে অত্যন্ত ভালো ছাত্র ছিলেন, পদার্থবিজ্ঞান তাঁর প্রিয় বিষয়ই শুধু নয়, তাঁর অবসেশান। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের তৃতীয় বর্ষে পড়াকালীন সব ছেড়ে ছুড়ে নাচ আর অভিনয় শিখতে ঢুকে গেছেন। যা হতে চেয়েছেন হয়েছেন, অভিনেতা। তাঁর ৫০টি স্বপ্নের কথা লিখে গেছেন, এমন স্বপ্ন বলিউডের কোনও অভিনেতা দেখেন না, এ আমি হলফ করে বলতে পারি। নাসায় তিনি ওয়ার্কশপ করেছেন, আবার আরেক ওয়ার্কশপের স্বপ্ন তাঁর। নভোচারী হওয়ার স্বপ্ন তাঁর। বিমান চালানোর স্বপ্ন তাঁর। নাসায় ১০০০ কিশোর-কিশোরী পাঠাতে চেয়েছেন মহাশূন্য সম্পর্কে যেন জ্ঞান লাভ করতে পারে। সুইজারল্যান্ডে বেড়াতে গেলে অন্যান্য অভিনেতা আর যেখানেই যাক, সার্নে যাবেন বলে মনে হয় না, সুশান্ত সার্নে গেছেন, যে বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রে গবেষণা হচ্ছে আলোর গতির চেয়ে দ্রুত আমাদের গতি হবে কিনা কখনও। সুশান্ত খুব দামি টেলিস্কোপ কিনেছেন, ও দিয়ে রাতের আকাশ দেখেন, কোটি কোটি নক্ষত্র, গ্রহ, গ্যালাক্সি দেখেন। সুশান্তর স্বপ্নের মধ্যে আছে পদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কে আরও পড়া, আরও জানা। এমন জ্ঞানপিপাসু, কৌতূহলী, প্রতিভাবান তরুণ ছিলেন বলিউডের গোবরে পদ্মফুল।

সুশান্তর মানসিক রোগ ছিল, এ কথা তাঁর প্রেসক্রিপশানই বলে। তাঁকে ডিপ্রেশানের ওষুধ দিয়েছিলেন তাঁর মানসিক-রোগের চিকিৎসক। তাঁর কাছের লোকেরা বলছেন, সুশান্ত নাকি অনেক দিন ওষুধ খাননি। ঠিক কী কারণে হাতের নাগালে তারকাখ্যাতি থাকার পরেও, ৫০টি স্বপ্নের বেশির ভাগই এখনও পূরণ না হওয়ার পরও তিনি নিজের জীবনের ইতি ঘটাতে চাইলেন, তা আমরা জানি না। তাঁর মস্তিষ্ক তাঁকে কী বলছিল সেই সকালে, যে কারণে তিনি দড়ি নিয়েছিলেন হাতে, সেটা আমরা কোনও দিন জানতে পারব না। মস্তিষ্কই বিশ্বব্রহ্মা-ের সবচেয়ে জটিলতম জিনিস।
সব মানুষই কম বেশি ডিপ্রেশানে ভোগে। তবে সুস্থ মানুষের ডিপ্রেশান আর মানসিক ব্যাধির ডিপ্রেশান এক নয়। একটি ডিপ্রেশান, আরেকটি ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার। ডিপ্রেশান থেকে উঠে আসা সহজ, কিন্তু ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার থেকে উঠে আসা সহজ নয়। একে সামাল দিতে নিয়মিত থেরাপি এবং ওষুধের দরকার হয়। অনেকে বলে, ভালোবাসা না পেলে বা একাকিত্বে ভুগলে ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারে ভোগা মানুষ আত্মহত্যা করে। তা ঠিক নয়। এই ডিসঅর্ডার যাদের আছে, তারা অগুনতি মানুষের, পরিবারের সবার এবং বন্ধুবান্ধবদের নিখাদ এবং অফুরন্ত শ্রদ্ধা ভালোবাসা স্নেহ পেলেও আত্মহত্যা করে। প্রচুর ভালো বন্ধু তাদের ঘিরে থাকলেও তারা আত্মহত্যা করে, কারণ তাদের মস্তিষ্ক তাদের অন্য বার্তা দেয়, যেটার সঙ্গে তাদের বাস্তব জীবনের কোনও সম্পর্ক নেই।

৩। বাংলাদেশের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপিকাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, কারণ তিনি ফেসবুকে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মৃত্যুর পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সামান্য কিছু লিখেছিলেন। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের এক টেলিভিশন এক তথ্য-তদন্ত-চিত্রে দেখিয়েছিল পাবনার এক সরকারি হাসপাতালে ঢাকার এক প্রাইভেট কোম্পানি হাসপাতালের জন্য কী কী সরঞ্জামাদি কিনতে হবে তা লিস্ট করে পাঠিয়ে দিয়েছে এবং অর্ডারে সই করতে অনুরোধ করেছে। হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ-ডাক্তার বলেছেন, তাঁর হাসপাতালে ওই সরঞ্জামাদির প্রয়োজন নেই তাই তিনি অর্ডারের কাগজে সই করবেন না। এর কিছুদিন পর পাবনার ওই হাসপাতাল থেকে কর্তৃপক্ষ-ডাক্তার স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে আসা বদলির কাগজ পান। রোমহর্ষক ঘটনা। তদন্ত করলে আরও জানা যায় যে ওই প্রাইভেট কোম্পানিটি দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে অর্ডার পাঠিয়ে দেন। একটি হাসপাতালে কী কী দরকার, তা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বুঝবেন, কিন্তু প্রাইভেট কোম্পানিকে কে দায়িত্ব দিয়েছে বোঝার এবং কোনও হাসপাতাল যদি কোম্পানি থেকে সরঞ্জামাদি না কেনে, তাহলে শাস্তি পাওয়ার ব্যবস্থাটা ওই কোম্পানি কী করে করে! কোম্পানির সঙ্গে খুব প্রভাবশালী লোকেরা জড়িত, তা সহজেই অনুমেয়। এসব দেখে যদি কেউ দুর্নীতির সমালোচনা করেন, তাহলে তাঁকে কি গ্রেফতার করাটা উচিত? যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে বিচার করলে বলতে হয়, নিশ্চয়ই উচিত নয়। দুর্নীতি বাড়তে থাকলে, অরাজকতা বাড়তে থাকলে, বাক-স্বাধীনতা কমতে থাকে, গণতন্ত্র হতে থাকে অর্থহীন একটি শব্দ। সে জন্যই ভয় হয়। মাঝে মাঝে ভাবি, দেশটায় গণতন্ত্রের কতটুকু অবশিষ্ট আছে। গণতন্ত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে বাক-স্বাধীনতা। গণতন্ত্রকে সম্মান করলে বাক-স্বাধীনতাকে সম্মান করতেই হয়।

এসব ছোটখাটো অগণতান্ত্রিক আচরণ মানুষকে খুব স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন করে। এখন পৃথিবীর কোথায় কী ঘটছে, তা পৃথিবীর সবাই আধুনিক প্রযুক্তির আশ্রয় নিয়ে মুহূর্তেই জেনে যেতে পারছে। সুতরাং আমি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, কিন্তু আমার মতের সঙ্গে মেলে না, এমন কোনো মতকে আমি সহ্য করি না, এই সহ্য না করার ব্যাপারটা শুধু দেশের মধ্যেই গোপন থাকবে- এটি শত চাইলেও আজকাল আর সম্ভব নয়।

বেগম রোকেয়া ছিলেন একজন সাহসী মানবতাবাদী, নারীবাদী। তিনি বাক-স্বাধীনতায় ভীষণ বিশ্বাস করতেন বলেই যে যুগে মেয়েদের অন্দরমহলে মুখ বুজে বাস করাই ছিল নিয়ম, তিনি সেই নিয়ম ভেঙে কথা বলেছেন, মেয়েদের পড়ালেখা করার, অর্থ উপার্জন করার, ঘরে বাইরে সর্ব ক্ষেত্রে সমানাধিকার পাওয়ার কথা খুব জোর দিয়ে বলেছেন। তিনি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারে, মতপ্রকাশের অধিকারে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতেন। তাঁর নাম দিয়ে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ হয়েছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি তাঁর আদর্শকেই মূল্য দেওয়া না হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম থেকে তাঁর অর্থাৎ বেগম রোকেয়ার নাম সরিয়ে দিয়ে অন্য কারও নাম বসানো হোক, যে নামের মানুষ বাক-স্বাধীনতার জন্য জীবনভর সংগ্রাম করেননি।

তাহলে অন্তত আমাদের শ্বাসগুলো এত দীর্ঘ হবে না, যত দীর্ঘ হচ্ছে এখন।

সেদিন আমি আমার এক পরিচিত বাংলাদেশি লোককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কেউ কেউ বলছে দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবা, হাসপাতাল ইত্যাদির নাকি বারোটা বেজেছে? স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ অনেক টাকাই নাকি নানান লোকে নিজেদের পকেটে ভরেছে? এটা কি সত্যি যে নিজের অসুখ হলে দেশে চিকিৎসা না করে চিকিৎসার জন্য খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিদেশে যেতে চেয়েছিলেন?’ লোকটি আমার প্রশ্ন শুনে মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন। গলা কাঁপছিল যখন বলছিলেন যে কাকপক্ষী যেন না জানে আমার এই প্রশ্নগুলো তিনি শুনেছেন। আরে প্রশ্ন তো আপনি করেননি, করেছি আমি! না এতেও তাঁর ভয় কাটেনি। বুঝতে পারলাম সরকার সম্পর্কে সমালোচনা করা তো অপরাধই, সমালোচনা শোনাও অপরাধ, এমনকী সরকারকে নিয়ে কারও কোনও প্রশ্ন শোনাও অপরাধ।

লোকটির প্রতিক্রিয়া দেখে আমার মনে পড়েছে চীনের অভিজ্ঞতার কথা। আমার এক প্রশ্ন শুনে আমার দো-ভাষী চৈনিক ভদ্র মহিলার যে প্রতিক্রিয়া দেখেছিলাম, তাতেই আমি চীনের বর্তমান অবস্থা বুঝেছিলাম। তিয়ানানমান স্কয়ারে দাঁড়িয়ে আমি শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আচ্ছা, এখানে সেদিন, ১৯৮৯ সালে, মোট কতজন মানুষকে মারা হয়েছিল?’ সঙ্গে সঙ্গে ভদ্র মহিলা ছিটকে সরে গেলেন, থর থর করে কাঁপতে লাগলেন, কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘কিছু জানি না, কিছু জানি না, আমরা কিছু জানি না সেদিন কী ঘটেছিল, আমরা কিছু দেখিনি, কিছু পড়িনি, কিছু শুনিনি, কিছু জানি না।’

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা। বাংলাদেশ প্রতিদিন