শনিবার ইনস্টাগ্রামে দু’টি ছবি প্রকাশ করেছেন অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়া । কিন্তু সেই পোস্টে কোনো মন্তব্য করার সুযোগই নেই। অথচ এর আগে প্রতিটি ছবি/পোস্টেই কমেন্ট করতে পারতেন নেটিজেনরা। তখন অনেকেই খারাপ মন্তব্য করে বসতেন। এমনকি গাল-মন্দ করতেও দ্বিধাবোধ করতেন না। তাই ইনস্টাগ্রামে মন্তব্যের অপশন বন্ধ করে দিয়েছেন অভিনেত্রী নিজেই।

এর আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাজে মন্তব্যের কারণে নিজেকে অনুসরণ ‘না করতে’ বলে ভীষণ ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন অভিনেত্রী আশনা হাবিব ভাবনা।

বিয়ে ও ব্যক্তিগত স্ক্যান্ডালের কারণে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনায় রয়েছেন অভিনেত্রী রাফিয়াত রশিদ মিথিলা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার পোস্ট মানেই হাজার হাজার নেতিবাচক কমেন্ট। তাই বিড়ম্বনা ঠেকাতে সম্প্রতি ইনস্টাগ্রামের পাবলিক কমেন্ট বন্ধ করে দিয়েছেন এই অভিনেত্রী। এখন থেকে মিথিলার পছন্দের বাইরে অন্য কেউ তাকে নিয়ে আর ‘কমেন্ট’ করতে পারছেন না। ‘সাইবার বুলিং’-এর শিকার হয়ে এমন অনেক তারকাই সমালোচনা পথ বন্ধ করে দিয়েছেন।

ফেসবুকে নারী ও শিশুদের ছবিতে খারাপ মন্তব্যের ঘটনা যে শুধু এই তারকাদের সঙ্গেই ঘটছে, তা কিন্তু নয়। ছোট-বড় অনেক তারকাই প্রতিনিয়ত সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। তারকা বা জনপ্রিয় ব্যক্তিদের বাইরেও ফেসবুকে এরকম আপত্তিকর মন্তব্যের শিকার হয়েছেন সাধারণ মানুষও।

বাংলাদেশি তারকাদের ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব অ্যাকাউন্টে ঢুঁ মারলেই চোখে পড়ে বহু কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য। বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মধ্যে ফেসবুকই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। তাই বাংলাদেশের তারকারা সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত হন ফেসবুকে। এসব পোস্ট তারকাদের যেমন বিব্রত করে, তেমনি কাজের প্রতি মনোযোগও নষ্ট করে। অনেকের মানসিক অবস্থাকে বিপর্যস্ত করে, যা তার ক্যারিয়ারেও প্রভাব ফেলে।

কোনো না কোনোভাবে এ হয়রানি তথা সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন দেশের বিনোদন জগতের প্রায় সব তারকা। কাজের আলোচনা এবং সমালোচনা করতে গিয়ে হত্যার হুমকিও অনেক সময় দেয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বছর দুয়েক আগে জনপ্রিয় অভিনেতা মোশাররফ করিমকে একটি চ্যানেলে নারীদের পর্দা নিয়ে একটি মন্তব্যের জন্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে হেনস্থা করা হয়। এমনকি হত্যার হুমকিও দেয়া হয়েছিল। অনেকটা বাধ্য হয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে ক্ষমা চাইতে হয়।

সাইবার বুলিং বিষয়টি যে প্রকট আকার ধারণ করছে সেটা মানছেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী জয়া আহসান। নিজেকে উদাহরণ হিসেবে মানেন তিনি। তার ফেসবুক পোস্ট দিয়েই উদাহরণের ইতি টানেন। তবে সাইবার বুলিংয়ের কষ্টটা তিনি পান বহুগুণে এবং ভিন্নভাবে। তিনি বলেন, যখন বিদেশে কাজ করতে যান এবং ওই দেশেরই ভক্তরা যখন বলেন- আপনাদের দেশেই আপনার ভক্তরা সম্মান দিতে প্রস্তুত নয়, আপনার ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রোফাইল দেখেই বুঝি। খারাপ লাগাটা এখানেই। তবে সব খারাপ লাগা এড়িয়ে গিয়েই কাজ করছি এবং করে যাব।

একটি কষ্টকর কাজ কিংবা সুন্দর একটা ছবি পোস্ট করে যখন অপ্রীতিকর কিছু শুনতে বা পড়তে হয় তাহলে অবশ্যই খারাপ লাগার কথা। সত্যিই কি খারাপ লাগে? এমন প্রশ্নের জবাবে ছোটপর্দার অভিনেত্রী মেহজাবিন চৌধুরী বলেন, সমালোচনার দিকে তাকিয়ে থাকলে আমাদের কাজেরই ক্ষতি। সুতরাং কারো কথায় কান না দিয়ে কাজ করে যাচ্ছি, ভালোই আছি।

এ বিষয়ে অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিষয়টি আমাদের জাতিগত অবনতি। তবে এটি শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা বিশ্বে হচ্ছে। সাইবার বুলিং বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সমালোচনাগুলো যে দেখি না বা পড়ি না, তা কিন্তু নয়। আমি আমার জায়গায় সঠিক। কাউকে জবাবদিহি করতে হবে বলে আমার মনে হয় না। তাই আমি আমার সঠিক কাজটাই করে যাচ্ছি। কারো সমালোচনায় কান দিচ্ছি না।

গত ২০ সেপ্টেম্বর নিজের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজে একটি ছবি আপলোড করেন অভিনেত্রী পরীমনি। ‌‘কুল’ ক্যাপশনের ওই ছবিটি ছিল একটি সুইমিং পুলে তোলা। গত এক সপ্তাহে ওই পোস্টে ১৯ হাজারেরও বেশি কমেন্ট করেছে নেটিজেনরা। এসব কমেন্টের ৯৮ শতাংশই ছিল কুরুচিপূর্ণ। এমনকি মন্তব্যের বদলে নানা রকম অশ্লীল ছবিও শেয়ার করেছেন অনেকে।

পরীমনি বলেন, প্রতিনিয়তই এ ধরনের বাজে মন্তব্যের শিকার হই। তবে এসব আপত্তিকর আচরণ ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্যের দিকে এখন তাকাই না। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি। এছাড়া ভুয়া আইডি নিয়ে অনেক যন্ত্রণার মধ্যে আছি। প্রতারকরা প্রতিনিয়ত আমার নামে নতুন নতুন আইডি খুলছে। এসব আইডির মধ্যে আমার পুরো নামসহ আরও রয়েছে- মিষ্টি মেয়ে পরী, রূপালী পরী, পরীকন্যা ইত্যাদি। সব আইডিতে আমার নতুন নতুন ছবি আপলোড করা হচ্ছে। তাই এটা যে ফেইক আইডি, তা ভক্তদের বোঝার কোনো উপায় থাকছে না।

কোন শ্রেণীর মানুষ এ ধরণের কটু মন্তব্য বেশি করছে? সাইবার বিশেষজ্ঞ জেনিফার আলম বলছেন, আসলে সব ধরণের শ্রেণীর মানুষই এ ধরণের মন্তব্য করে। তবে সবচেয়ে বেশি করে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষজন। এজন্য তাদের মধ্যে হতাশা ও বিনোদনের অভাব একটা প্রধান কারণ। এছাড়া আমাদের এখানে সাধারণ সৌজন্য বোধের অনেক অভাব রয়েছে।

ফেসবুক বা সামাজিক মাধ্যমে খারাপ মন্তব্য করার কারণে বিভিন্ন সময় অনেককে আটক করেছে বাংলাদেশের কাউন্টার টেরোরিজমের সাইবার ক্রাইম ইউনিট। গ্রেফতারকৃতরা এরকম কর্মকাণ্ডের পেছনে কী যুক্তি দেন? ইউনিটের প্রধান আ ফ ম আল কিবরিয়া বলেন, নিজেদের প্রচারণা বাড়ানোর জন্য কেউ কেউ এটা করে, পেজের ভিউ বাড়ানোর জন্য। আরেক ধরণের মানুষ মনে করে, এটা একটা আলোচনার টপিক হলো। আমি একটা কমেন্ট করলাম, তাতে আমাকে গালিগালাজ করলেও অনেক মানুষ আমার প্রোফাইলে ঢুকবে। হয়তো আমার ফলোয়ার বাড়লো, ফ্রেন্ড বাড়ল। এসব উদ্দেশ্যে অনেকে করে।

তারকাদের যেমন নিত্যদিন ট্রোলড হতে হয়, তেমনই রেহাই নেই সাধারণ মানুষের। একটা ছবি পোস্ট করার আগে ‘অন্য লোকে কী ভাববে’, তা মাথায় রাখতে হয়। কম্পিউটারের আড়ালে একদল মানুষ ক্রমাগত অন্যকে বিচার করে, হেনস্থা করে চলেছে। যেকোনো সুস্থ শিল্পী এমনকি সুস্থ মানুষকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে দেয়ার জন্য এই একটা কারণই যথেষ্ট। তারকাদের অনেকে বলেছেন, সাইবার অপরাধ বিভাগ যত দ্রুত ব্যবস্থা নেয়, তাহলে এই ধরনের অপরাধ কমে যায়। সূত্র: ডেইলি বাংলাদেশ